গল্প - ৪ । অগ্রহায়ণ ১৪৩১



         বন্ধু 











অসিত কর্মকার
কলকাতা, পশ্চিম বঙ্গ



 

প্রভাস আমার সহপাঠী শুধু নয় বন্ধুও। রোগাপাতলা, তামাটে রঙ চেহারা। গোলাকার মুখমন্ডল। ভাসা ভাসা চোখ দুটো বড় মায়াবী। চ্যাপ্টা বর্তুল নাক। একমাথা লালচে কোঁকড়ানো চুল। গ্রামের হোগল নদীর ওপারে ওদের পৈত্রিক বাড়ি। সেখানে কোনও হাই স্কুল নেই। তাছাড়া ওর বাবার কাজ পাওয়ার সুবিধার জন্য ওরা আমাদের গ্রামে এসে বসবাস শুরু করল। আমাদের স্কুলে ভর্তি হল ও। বড় সহজ সরল মনের ছেলে। কদিনের মধ্যেই ওর সঙ্গে আমার বেশ বন্ধুত্ব গড়ে উঠল। 

গরমের ছুটি পড়ল। স্কুল শেষে সবাই হৈচৈ করতে করতে  ক্লাশ থেকে বেরিয়ে পড়লাম। এক মাসের লম্বা ছুটি। মন যেন আমাদের বাঁধন হারা উড়ালপাখি। 

প্রভাস বলল, আমাদের বাড়ি যাবি, অন্তু? পরক্ষণেই শুধরে নিয়ে বলল, না, মানে, আমাদের ভাড়া ঘরে? 

আমি কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কেন রে? 

তোকে একটা জিনিস দেখাব। 

কী জিনিস? 

দেখাব, চলই না! 

আন্তরিকতার সঙ্গে একরকম জোরই করতে লাগল প্রভাস। চোখেমুখে আলোর ছোঁয়া। বুঝলাম, রহস্য কিছু একটা আছে। 

আমি মজা করে বললাম, সে না হয় দেখতে যাব কিন্তু কী খাওয়াবি বল? 

ওর মুখমণ্ডল হঠাৎ কেমন ভাষাশূণ্য মেদুর হয়ে উঠল। অস্ফুটে বলল, আমাদের মাটির কলসির ঠান্ডা জল! 

আমি খানিক অবাক হলেও মনের দিক থেকে ওদের দারিদ্রের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে বললাম, এই গরমে ঠান্ডা জল দারুণ লাগবে। তেষ্টাও পেয়েছে খুব! এও বুঝলাম, মজা করেও ওই কথাটা বলা আমার উচিত হয়নি। একটু বিব্রতই বোধ করছিলাম। 

      বিকেলের বাসি হলুদরঙ ম্লান আলোয় চারিদিক ডুব দিতে লেগেছে। ছায়া ছায়া আকাশের পটে দল বেঁধে পাখিদের ঘরে ফেরার নানা চিত্রমালা। স্কুলের খেলার মাঠ ফেলে পেছনের রাস্তাটা সোজা মাখালপাড়ার দিকে চলে গেছে। ভাঙ্গাচোরা, চড়াইউৎরাই সরু রাস্তা। ধুলোয় মাখামাখি। এমন রাস্তায় হাঁটতে বেশ মজা। ধুলোমাখা পায়ে এই উঠছি, এই নামছি, এই বুঝি টাল খেয়ে পড়েই গেলাম! দুপাশে খড়বিচালি ছাওয়া ছোট ছোট মাটির ঘর। উঠোনে মুরগি, পুকুরে হাঁস। বড়দের সাংসারিক কাজকর্মে ব্যস্ততা। ছোটদের হুটোপুটি করে খেলাধুলো। মাথার ওপর গাছেদের ছায়া। এমনই এক ঘুপসি ঘরে প্রভাসদের বসবাস। সামনে একচিলতে বারান্দা। তার এক পাশে মাটির পাতা উনুন। পাশ দিয়ে শুকনো কাঠকুটোর স্তুপ। মাটির হাড়িকুড়ি, বাসনপত্র। বারান্দার অন্য পাশে বসে ওর মা কাঁথা সেলাইয়ে মগ্ন। ছেলের সঙ্গে আমাকে দেখে লজ্জা পেয়ে মাথার ঘোমটাটা বড় করে টেনে দিলেন। মনে মনে খানিক মজাই উপভোগ করছিলাম। 

প্রভাস ওর মায়ের উদ্দেশ্যে বলল, মা, এ আমার নতুন স্কুলের নতুন বন্ধু, অন্তু। আমরা এক ক্লাশে পড়ি। 

ওর মা স্মিত হেসে স্নেহমাখা গলায় বললেন, এসো বাবা, ঘরে এসে বসো। গরীবের কুটির... 

আমি মাসিমাকে প্রণাম করতে যেতে উনি সচকিত হয়ে বললেন, থাক বাবা থাক। ভাল থাক। অনেক বড় হও! 

উনি পা  সরিয়ে নিতে চাইলে কী হবে, আমি জোর করেই প্রণাম করলাম। 

ছেলের উদ্দেশ্যে বললেন, যাও পেভা, বন্ধুকে ঘরে নিয়ে বসাও। 

আঁধার জড়ানো স্যাঁতস্যাঁতে ঘর। ছিটে বাবলার  দুটো ঘুলঘুলি। একপাশে একটা তক্তপোশ। তাতে কটা জীর্ণপ্রায় মলিন কাঁথা, বালিশ, চাদর। দেয়ালে ঝোলানো একটা বাঁশের টুকরোয় রাখা জামাকাপড়। আমাকে তক্তপোশে বসাল ও। তারপর তক্তপোশের নীচে থেকে একটা ছোট জঙ্ ধরা বিবর্ণ তোরঙ্গ টেনে বার করল। তালাচাবি দেওয়া নেই। ডালাটা টেনে খুলতে যেতে কড়্ কড়্ আওয়াজ হল। ভেতর থেকে খবরের কাগজে মোড়ানো, সুতলি দিয়ে বাঁধা একটা প্যাকেট গোছের কিছু বার করে আনল।  মোড়কটা খুলে ফেলতে দেখলাম একজোড়া রঙিন কাচের গ্লাস। তাতে কী সুন্দর বাহারি কারুকার্য। 

বললাম, দারুণ দেখতে তো! 

ওর দুচোখে আলোর ঝিলিক খেলে গেল। বলল, বাবার পাওয়া পুরস্কার। যাত্রাপালায় বাঁশি বাজিয়ে পেয়েছে। এতে করে তোকে জল খাওয়াব। 

আমি বাধা দিয়ে বললাম, এগুলো পুরস্কারের জিনিস। এঁটো করতে নেই। যত্ন করে রেখে দিতে হয়। অন্য গ্লাসে দে। 

প্রভাস নাছোড়বান্দা। ওই গ্লাসে করেই আমাকে জল খাওয়াবে। তাতে করে ও নিজেই যেন তৃপ্ত হবে। অগত্যা... 

ও একটা গ্লাসে করে মাটির কলসির ঠান্ডা জল ভরে নিয়ে এল। কী সোয়াদি ঠান্ডা জল! বুকটা জুড়িয়ে গেল। বললাম, দারুণ! তারপর গ্লাসটাকে চোখের সামনে নেড়েচেড়ে দেখছিলাম, সত্যিই দেখার মতো। আলোআঁধারি ঘরে রঙিন কাচের মায়াবি আলোর ছটা! আমি যত দেখছি ততই ওর মুখমণ্ডল আলোকিত হয়ে উঠছিল। বাবার পাওয়া পুরস্কার, তাতে করে প্রিয় বন্ধুকে জল খাওয়াতে পারা যেন ওকে অপার্থিব এক আনন্দ দিচ্ছিল। গ্লাসটা  ওর হাতে তুলে দিয়ে বললাম, ধুয়ে যত্ন করে তুলে রাখ। এবার তাহলে আসি রে। দেরি হচ্ছে, বাড়িতে চিন্তা করছে। 

ও আকুতিভরা কন্ঠে জিজ্ঞেস করল, আবার আসবি তো! 

প্রভাসের বয়সই শুধু বেড়েছে, ভেতরে শিশু মনটা একই রয়ে গেছে। পড়াশোনায় ভাল না।  পেছনের দিকের বেঞ্চে বসে। তাহলেও  সবার মন জয় করে নেওয়ার এক অদ্ভুত ক্ষমতা ওর। কেন জানি না, আমার প্রতি ওর এক অদ্ভুত চাপা অথচ গভীর ভালবাসা, বন্ধুবাৎসল্য। কী এক দ্বিধা সঙ্কোচে তা ও প্রকাশ করত না। হাবভাবে, আচরণে বুঝিয়ে দিত। হয়ত পড়াশোনায় ভাল ছিল না বলেই ও এমনটা করত। কিন্তু আমি তো জানি, আমারও কী অদ্ভুত এক টান তৈরি হয়েছিল ওর প্রতি। শুধু পড়াশোনায় ভালমন্দ হওয়া দিয়ে তো আর বন্ধুত্বের বিচার হয় না! 

টিফিন প্রিয়ডে   নিচু ক্লাশের ছেলেদের সঙ্গে খেলাধুলো করে মজা পেত। কী জাদুবলে দিব্যি ওদের মন জয় করে নিয়েছিল। যেন ও ওদেরই বয়সী, ওদেরই সহপাঠী। স্কুলের বাইরেও ওদের সঙ্গে খেলাধুলো, মেলামেশা করে সময় কাটাত। পাড়ায় বেপাড়ায়, মাঠেঘাটে সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে ওর এই বিচরণ আমাদের মজা দিত। আমরা ফুটবল, ক্রিকেট চুটিয়ে খেলতাম। ওসব খেলা নিয়ে দেশের হয়ে মাতামাতি করতাম। অনেক জোরাজুরি করেও ওকে আমরা মাঠে নামাতে পারতাম না। গুলি, ডাঙ্গুলি, ঘুড়ি উড়ানো, পিট্টু, লাট্টু খেলা ছিল ওর  প্রিয় খেলা। শীত পড়তে না পড়তে ওর দুই পকেট ভর্তি গুলি। হাতে ডাঙ্  আর গুলি। বিশ্বকর্মা পুজোর দিন থেকে শুরু হত ওর ঘুড়ি উড়ানোর পালা। হাতে লাটাই আর সুতোর মাথায় ঘুড়ি বেঁধে চলল ফাঁকা মাঠে। সঙ্গে সাঙ্গপাঙ্গরা। ওদের হাতে হাতে ওর নিজের হাতে তৈরি করা ঘুড়ি, পাকা বাঁশের গোড়ার টুকরো দিয়ে বানানো লাটাই। অত পয়সা কোথায় যে কিনে সখ মেটাবে। 

নাওয়া খাওয়ায় হুশ নেই, ঘুড়ি কাটাকাটিতে মত্ত প্রভাস। কোনও কোনও দিন দিনের আলো ফুরিয়ে আঁধার নেমেছে পৃথিবীতে। তারারা আকাশে উঁকিঝুঁকি দিতে শুরু করেছে। তখনও ওর ঘুড়ি আকাশ প্রান্তে আরেকটি তারা হয়ে ঝুলছে।  লাটাই চালানোর কেরামতিতে সে ঘুড়ি কত না খেল দেখাত। যেন ও চলমান এক তারার আঁকিবুকি খেলার চিত্র আঁকে আকাশের ক্যানভাসে। এমনই এক গোধূলি বেলায় ও আমাকে পেয়ে হৃষ্ট মনে বলল, তুই উড়াবি, অন্তু? নে ধর। 

বলেই ও লাটাইটা আমার হাতে ধরিয়ে দিল। সহসা আমি তো ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে একেবারে বোকা বনে গেলাম। কস্মিনকালেও ঘুড়ি উড়াইনি। এ খেলায় আমি অ আ ও নই। লাটাইটা হাতে নিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে বোকার মতো দাঁড়িয়ে আছি। কিছু ধূসর মেঘ আর পুবাকাশে ম্লান আলোর ছটা। ওই মেঘেদের খানাখন্দে কোথায় ওর ঘুড়িটা কাটাকাটি খেলছে! ওর মনে হল, আমার দৃষ্টিশক্তি দুর্বল। বলল, সে কী, ঘুড়িটা তুই দেখতে পাচ্ছিস না! আকাশের দিকে আঙুল উঁচিয়ে বলল, ওই তো, ওই..., দুটো ছোট মেঘের ফাঁকে...। 

প্রভাস যেন ওর হাতের তালুতে দুটো মেঘ নামিয়ে এনে তার মাঝে সাধের ঘুড়িটাকে বসিয়ে আমাকে পরিস্কার দেখিয়ে দিতে চাইছিল। ব্যাপারটা এমনই সহজ ওর কাছে। আরেকটু সময় যেতে তারাদের মেলায় হারিয়ে গেল বুঝি ঘুড়িটা। আমি হাল ছেড়ে দিয়ে বাড়ির পথ ধরতে চাইলে ও বলল, কয়েকদিন আমার সঙ্গে থাকলে শিখে যাবি। একদম সোজা। চলে আসিস। 

আমি মনে মনে বললাম, মাথা খারাপ! মনে হল, ঘুড়িটা ওই সুতোর মধ্যে দিয়ে ওকে খবর পাঠায়, ও ঠিক কোথায় আছে তা জানায়। আকাশের কোন প্রান্তে, কোন নক্ষত্রবলয়ে। মেঘের ঘোমটা পরে, নাকি আলোকিত হয়ে। 

গুলি আর লাট্টুর হারজিত খেলায় তুখোড় ও। জিতে ছোটদের মধ্যে অকাতরে বিলিয়েও দিত। তখন ওর সারা মুখে অনাবিল, উদার হাসির আলো। ডাঙ্গুলি খেলায় ডাঙ দিয়ে গুলিটাকে এমন জোরে মারত যে, গুলি সাঁইসাঁই শব্দ করে ছুটত। তার সামনে দাঁড়ায় কার সাধ্যি! ওই রোগাপ্যাটকা চেহারায় এত শক্তি যে ও কোত্থেকে পেত! গেমটিচার গোবিন্দস্যার বলতেন, ওটা ওর ভেতরের শক্তি। সবার থাকে না! 

এই ভেতরের শক্তিটা যে কী তা আমরা ঠিক বুঝে উঠতে পারতাম না। বিস্মিত হতাম শুধু। পিট্টু খেলায় ওর হাতের টিপ ছিল সাঙ্ঘাতিক।একবারেই পিট্টুর চাড়ার স্তম্ভ ভেঙ্গে ছত্রাখান করে দিত। আর  যতরকম গুলি খেলা আছে তাতে জেতা ছিল ওর কাছে জলভাত। 

শীত পড়তে গ্রামে রামযাত্রা পালার ধুম পড়ত। আর ছিল স্কুল আর ক্লাবের উন্নয়নকল্পে যাত্রা পালার আয়োজন। পালা শেষ হওয়ার পরেও কয়েকদিন ধরে সে পালার রেশ গ্রামময়  ছড়িয়ে থাকত। ছোটরা এখানে ওখানে জড়ো হয়ে পালার অংশ বিশেষ অভিনয় করে বেড়াত। চলতে ফিরতে মুখে মুখে কুশীলবদের ডায়লগ আওড়াত। এমনকী মেয়েদের গলা করে সীতা, সূর্পণখা, মন্দোদরীর ভূমিকায়ও অভিনয় করত। প্রভাস পালন করত খোদ রাবণের ভূমিকা। সে কী তার বজ্রকন্ঠে কঠিন কূটিল নিষ্ঠুর অট্টহাসি। কচুর ডাঁটির চাবুক হাতে বন্দিনী সীতার উদ্দেশ্যে ডায়লগ আওড়াত, 

বল ছুঁড়ি, বল ছুঁড়ি, 

আমায় ভজবি  কিনা বল! 

নয়ত, সপসপাসপ বেতের ঘায়ে 

রক্ত করব জল! 

বলেই ফের ওই অট্টহাসি। চাবুক হাঁকানো। ওই চেহারায় রাবণের ভূমিকা কী যে বেমানান ছিল। আমরা হাসাহাসি করতাম। ওর আরও যত কান্ডকারখানায় মজা উপভোগ করতাম। বলাবলি করতাম, প্রভাসটা আর বড় হল না! ও কিন্তু ভ্রুক্ষেপহীন। গ্রামের প্রান্তে বড় গাছের ছায়ায় সাঙ্গপাঙ্গদের নিয়ে রামযাত্রা পালা লাগিয়ে দিত। তাতে ও যথারীতি রাবণের ভূমিকায়। তরুণ অপেরার হিটলার যাত্রাপালায় হিটলারের ভূমিকায় শান্তিগোপালের অভিনয় গ্রামে আলোড়ন ফেলে দেয়। তা থেকে কি প্রভাস নিজেকে আলাদা রাখতে পারে! নিজেই হিটলার হয়ে গেল। প্রতিটি ডায়লগ শেষে হিটলাররূপী প্রভাসের দুটি শব্দের বজ্রকন্ঠ ঘোষণা, আমি হিটলার!! যা শুনে দর্শকদের কিনা পিলে চমকে গিয়েছিল। সেটাই ও রাস্তাঘাটে চলতে ফিরতে থেকে থেকে চিৎকার করে বলে উঠত। শুনে পাঁচজনে বলত, পাগল ছেলের কান্ড দেখ! অনেকে ওকে হিটলার নামে ডাকতেও  শুরু করে দিল। হাসিমুখে তাতে সাড়াও দিত ও। যেন হিটলার হতে পেরেও খুশি। 

ও শুধু সৎ ছিল না, ছিল  বিশ্বাসীও। অন্যদেরও  বিশ্বাস করত। ভূত প্রেত, দত্যিদানোয় বিশ্বাস ছিল প্রবল। ওসব কাহিনি শোনায় আর বলায়  আগ্রহ ছিল প্রচুর। বলতেও পারত খুব মনোগ্রাহী করে। আমরা বুঁদ হয়ে শুনতাম। বিশ্বাস করা, না করাটা বড় কথা ছিল না, ও যে পুরোটাই আমাদের শুনিয়েই ছাড়তে পারত সেটাই ছিল ওর সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব। 

একদিন আমাকে চুপি চুপি বলল, জানিস অন্তু, আমাদের পাড়ায় যে বুড়ো তেঁতুল গাছটা আছে, তাতে ভূত আছে। গোভূত! 

আমি অবাক হওয়ার ভান করে বললাম, তাই নাকি? যে তেঁতুল গাছটার পাশে পশু চিকিৎসালয়? 

হ্যাঁ, হ্যাঁ। 

কী করে জানলি? 

অনেককেই নাকি গোভূত দেখা দিয়েছে। তবে কারোর কোনোও ক্ষতি করেনি। গরু তো, নিরীহ জীব! যে গরুগুলো চিকিৎসার জন্য আনতে না আনতে মারা যায় সেগুলো ভূত হয়ে ওই তেঁতুল গাছে বাসা নেয়। 

আমি জিজ্ঞেস করলাম, কীভাবে দেখা দেয়, রাত করে ওই গাছটার দিকে তাকালেই, নাকি গাছ থেকে নেমে এসে পিছু নেয়? 

না না, ও আমাকে বাধা দিয়ে বলল, ওভাবে নয়, ওই গাছে নিজের নাম লেখাতে হয়। যারা সাহসী তারাই লেখায়। ওইদিন রাতেই গোভূত তাকে দেখা দেয়।

    খুব ছোট বয়স থেকে এই গ্রামে আমার বেড়ে ওঠা। কোনও দিন শুনিনি যে ওই গাছটায় ভূত বাস করে। বুঝলাম, কেউ ওকে মিথ্যে গালগল্প শুনিয়েছে। ওর সাদা মনে কাদা নেই, বিশ্বাস করে নিয়েছে। আমি ব্যাপারটাকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়ার ভান করে বললাম, তাই বুঝি, তা কে বলল তোকে ওই গোভূতের দেখা দেওয়ার কথা? 

ও বলল, নন্দু  জ্যেঠু। 

ও নন্দু জ্যেঠু! নন্দু জ্যেঠুর গোভূত যখন তখন সে তো পড়াশোনা জানা হতেই হবে! মাখাল পাড়ার বৃদ্ধ নন্দু মাখাল, গ্রামের সবার জ্যেঠু সে। সুবল দত্তের পান, বিড়ি, সিগারেটের দোকানে কাজ করে। দুলে দুলে বিড়ি বাঁধে। বানিয়ে বানিয়ে গল্প ফাঁদার অদ্ভুত সহজাত ক্ষমতা নন্দু জ্যেঠুর। এমনকী, নিজেকেও এক চরিত্র করে গল্প ফেঁদেছিল সে। জোয়ান বয়সে সে নাকি সুন্দরবনে কাঠ কাটতে গিয়ে বাঘের মুখে পড়ে। বাঘের সঙ্গে সে কী তার রোমহর্ষক ধুন্ধুমার লড়াই। বাঘকে কুপোকাত করে সে বুক ফুলিয়ে ঘরে ফেরে। তার মুখমণ্ডলে যে গর্ত গর্ত দাগগুলো আছে ওগুলো নাকি বাঘের নখের দাগ। আসলে ঘটনাটা তা নয়, ছোটবেলায় নন্দু জ্যেঠুর কঠিন বসন্ত রোগ হয়। ওই রোগেরই দাগ ওগুলো। যারা জানে না তারা বাঘের নখের দাগ বলে দিব্যি বিশ্বাস করে। তবে নন্দু জ্যেঠু বানানো ঘটনা এত আস্থার সঙ্গে বলত যে শুনে মনে হত একেবারে সত্যি ঘটনা। প্রভাসকে এই গ্রামে নতুন পেয়ে শুনিয়ে দিয়েছে গোভূতের অবাস্তব কাহিনি। ভূতপ্রেতে ভয়ভীতি আমার ছোটবেলা থেকেই নেই। যাত্রাপালা, অনুষ্ঠান ইত্যাদি দেখে ঘুটঘুটে অন্ধকার রাতগভীরে অনায়াসে বাড়ি ফিরতাম। তবে একবার সত্যিই আতঙ্কিত হয়েছিলাম। না, ভূতপ্রেত দেখে নয়, মরা চাঁদের মেদুর আলোয় কালকেউটে ফণা বাগিয়ে দাঁড়িয়ে, বেখেয়ালে গায়ে পা তুলে  দিয়েছিলাম আর কী! বললাম, আমি ওই তেঁতুল গাছে আমার নাম লিখে আসব। দেখি গোভূতে আমায় কেমন দেখা দেয়! 

ও ভয়কাতর গলায় বলল, তুই ভয় পেয়ে অজ্ঞান হয়ে যেতে পারিস, অন্তু। ভূতপ্রেতের মোকাবেলা করতে কলজের জোর লাগে, এই দুঃসাহস তুই দেখাস না! 

    বুঝলাম ও আমার ক্ষতি চায় না বলেই এমনটা বলছে। শুনলাম না। জেদ করে সেদিনই ক্লাশের ব্ল্যাকবোর্ডের নীচে পড়ে থাকা টুকরো টুকরো চক থেকে একটা টুকরো কুড়িয়ে নিয়ে পকেটে ভরে নিলাম। ছুটির পর ওকে বললাম, আজই আমি গাছে নাম লিখব, চল

মস্ত বড় বুড়ো তেঁতুল গাছ। বিঘে খানেক জায়গা জুড়ে শীতল ছায়া ছড়িয়ে অটল দাঁড়িয়ে। তিন মানুষের হাতের বেড়ের সমান তার কালচে কান্ড। তেমনি গভীর, ঘন জঙ্গল মতো তার ডালপালা ছড়ানো। সেদিকে তাকিয়ে আমি পাতা, ফুল, ফল আর পাখিদের ওড়াউড়ি আর নাচানাচি দেখছি। ওখানে কোথায় গোভূত! শুধু পাতা আর ফুল নীচে ঝরে ঝরে পড়ছে। 

ও বলল, কী দেখছিস? 

আমি বললাম, ভূত খুঁজছি। 

তুই তো দেখছি কিছুই জানিস না, অন্তু। দিনমানে কি ভূত দেখা যায়? এখন ওরা বাতাসের সঙ্গে মিশে অদৃশ্য হয়ে আছে। রাত নামলে অন্ধকারের জোব্বা পরে নিজেদের আকার নেয়। তারপর কাজকর্মে নেমে পড়ে। 

আমি হাসতে হাসতে বড় বড়, গোটা গোটা অক্ষরে গাছটার কান্ডে নিজের নামটা লিখে দিলাম। যাতে করে অনেক দূর থেকেও পরিস্কার পড়া যায়। এখন গোভূতেরা ওটা ডালে বসে পড়ুক কিম্বা নীচে নেমে এসে পড়ুক, যা খুশি। জোয়ান থেকে বৃদ্ধ, সব গোভূতেরই পড়ার সুবিধা রাখা হল। 

না, সেদিন রাতে গোভূত আমায় দেখা দেয়নি। না অন্ধকারে চলতে ফিরতে, না স্বপ্নে। জানলার পাশে পড়ার টেবিলে বসে বাইরের ঘুটঘুটে অন্ধকারটা আর পাঁচটা দিনের মতোই ছিল। রাতচরাদের ডানা ঝাপটানোর শব্দ আর জোনাকিদের ওড়াওড়ি, গাছেদের নীচে পড়ে থাকা শুকনো পাতার উপর দিয়ে খসখস শব্দ করে ইঁদুরের দৌড়োদৌড়ি শুধু। আমি যেচে ভূতের দেখা পেতে চাইছি অথচ ভূত আমায় দেখা দিচ্ছে না। কী অদ্ভুত ব্যাপার! 

শুনে ও বলল, আসলে তুই খুব ভাল। তোর মনে কোনও পাপ নেই। তাই ভূত তোর ধারেকাছে ঘেঁষতে পারেনি। 

আমি কত আর হাসব। জিজ্ঞেস করলাম, এও কী নন্দু জ্যেঠু বলেছিল? 

ও চুপ। 

পুজো আসছে পুজো! পুজো মানে অনাবিল আনন্দের উৎসব পালন। প্রভাসের কাছে তা ছিল মহা আনন্দ উপভোগ। আকাশে বাতাসে তখনও পুজো পুজো ভাব লাগত না, কাশফুলও ফোটা শুরু হয়নি, দেবদেবীর কাঠামো বাঁধা শুরু হয়েছে মাত্র অথচ ওর মনে তখন থেকেই পুজোর ঢাকঢোল, কাঁসর বেজে উঠত। দেরি আর সয় না। দুবেলা ঘুরেফিরে কুমোর গৌরাঙ্গ পালের মূর্তি গড়ার কারখানায় ঢুঁ মারত। ঠাকুর গড়া কতদূর এগোল তা আমাদের সবিস্তারে বলে আনন্দ পেত। তখন আমাদের গ্রামে দুটো মাত্র পুজো। হিন্দুস্তান পট্টি আর পাকিস্তান পট্টির পুজো। দুটো পুজোই বাজারের মধ্যে হয়। দুইয়ের মাঝে দূরত্ব সিকি মাইলও না। দেশভাগ হতে যারা পূর্ব পাকিস্তান থেকে এপার বাংলায় চলে এসেছে তারা উদ্যোগ নিয়ে দুর্গা পুজো শুরু করে। তাই ওই নাম। ফলে স্থানীয় বাসিন্দারা অনেক বছর ধরে যে পুজোটা করে আসছে সেটা, হিন্দুস্তান পট্টির পুজো, নাম পায়। এর স্থায়ী পাকা পুজো মন্ডপ। পাকিস্তান পট্টির পুজো হয় প্যান্ডেল বেঁধে। ছোট্ট বাজার। বিদ্যুৎহীন গ্রাম। দোকানে দোকানে হ্যাজাক আর হ্যারিকেন জ্বলত। তাদেরই আলো ঠিকরে এসে খানিক রাস্তায় পড়ত। জেনারেটর চালিয়ে মন্ডপে আলোর ব্যবস্থা হত। রাস্তার দুদিক ধরে কিছু টুনি লাইটের সারি। এসব মিলিয়েই আমাদের শারদ উৎসবের আলোর রোশনাই। অনাড়ম্বর, ছিমছাম দুই পুজোর মধ্যে আমরা অনবরত পাক খেয়ে উৎসব উপভোগে মাততাম। হাতখরচের পয়সা দিয়ে নাগরদোলা চড়ি। চপ, বেগুনি, ফুলুরি আর প্লেট প্লেট ঘুগনি, আলুরদম খাই। ক্লান্ত হয়ে পড়লে এখানে ওখানে বসে বিশ্রাম নিই। কখনো নদীর খেয়াঘাটে গিয়ে বসি। ব্যস্ত খেয়াঘাট। ওপারের লোক নৌকো বোঝাই হয়ে এপারে আসছে ঠাকুর দেখতে। এপারের লোক যাচ্ছে ওপারে। এপারের ঢাকঢোল আর কাঁসরের শব্দ ওপারে ভেসে যায়। ওপারেরটা ভেসে আসে এপারে। দুই পারের মাঝে নদী ছোট ছোট আলোর ঢেউ ছড়িয়ে বয়ে যেতে থাকে। মাথার ওপর তারাদের আলোর মেলা। বেশ লাগত। 

প্রভাসের পুজোর আনন্দ উপভোগ ছিল একদম আলাদা। দশ ক্লাশের ছাত্র, পঞ্চমীর দিন থেকেই  দুহাতে দুটো খেলনা পিস্তল। পকেট ভর্তি ক্যাপ। সঙ্গী সেই ছোটরা। দুটো দল তৈরি করে এখানে ওখানে যখন তখন যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা লাগিয়ে দিচ্ছে। পিস্তলে ক্যাপ ফাটার পটাস পটাস  শব্দের সঙ্গে গলা মিলিয়ে ও  চিৎকার করে বলে উঠত, দুমদুম, পটাস পটাস! পরণে সস্তার নতুন জামা প্যান্ট, খালি পা। কী অনাবিল আনন্দই না উপভোগ করত! খিদে তেষ্টার বালাই নেই। থেকে থেকে মুখে শুধু আনন্দ উচ্ছাস ধ্বনি। অথচ খেলনা পিস্তল নিয়ে খেলার বয়স আমরা ফাইভ সিক্সেই ফেলে এসেছিলাম। এখন আমরা রীতিমত সিনিয়র স্টুডেন্ট। নিচু ক্লাশের সবার দাদা, দিদি।  সমীহ করে চলত। কিন্তু ওই সম্মান, সমীহে  ওর কোনও ভ্রুক্ষেপ ছিল না। এখনও খেলনা পিস্তল হাতে ছেলেমানুষ! 

গরমকাল। একদিন স্কুল ছুটির পর সবাই দল বেঁধে বাড়ি ফিরছি। প্রভাস দুজনের সঙ্গে বাজি লড়ে বসল। জোয়ারে ভরা হোগল নদী কে আগে পার হতে পারে। যে জিতবে তাকে বাকি দুজনে মিলে একশো গ্রাম জিলিপি খাওয়াবে। বইপত্তর নদীর পাড়ে রেখে ওয়ান টু থ্রি বলেই তিনজনে ঝুপ ঝুপ করে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে পড়ল। আমরা ভিড় করে বাজি লড়া দেখছি। ঘটনাটা বুঝতে গেমটিচার গোবিন্দস্যার ভিড়ে সামিল হলেন। শুনে বললেন, জোয়ারে ভরা নদী, একটু রিস্কি বাজি, তাও দেখা যাক কে জেতে। 

স্যার বাড়ি ফেরা ভুলে গেলেন। প্রভাস সবার আগে সমান গতিতে সাঁতরে চলেছে। আমরা চিৎকার করে যার যার পছন্দের সাঁতারুকে উৎসাহ দিয়ে চলেছি। আমি অবশ্যই প্রভাসের হয়ে গলা ফাটাচ্ছি। ওরা মাঝ নদীর কাছাকাছি আসতে না আসতে আমরা দেখলাম নবীন আর অনন্ত রণে ভঙ্গ দিয়ে ফিরে আসছে। প্রভাস কিন্তু তা করল না, ও আরও জোর গতিতে ওপারের দিকে সাঁতরে চলল। নবীন আর অনন্ত পাড়ে উঠে এসে একরকম সমস্বরে বলল, মাঝ নদীতে বড্ড ভয় করছিল! ততক্ষণে প্রভাস ওপারে পৌঁছে পাড়ে দাঁড়িয়ে বড় হাসি হেসে আমাদের উদ্দেশ্যে ঘন ঘন হাত নাড়তে লাগল। আমরাও ওর উদ্দেশ্যে হাত তুলে জয়ধ্বনি দিয়ে উঠলাম। স্যার বললেন, এই হল আসল লড়াকু ছেলে। শুধু দক্ষতা আর গায়ের জোর থাকলেই হয় না, সেই সঙ্গে চাই তাৎক্ষণিক বুদ্ধি এবং সাহস। যা ওর রয়েছে। নবীন আর অনন্ত ফিরে না এসে ওপারের দিকেই তো সাঁতরাতে পারত। মোটামুটি একই তো দূরত্ব। তাতে করে বাজিতে না জিতলেও প্রতিযোগিতা শেষ করার কৃতিত্ব তো অর্জন করতে পারত। যাকে বলে, স্পোর্টসম্যান স্পিরিট। তারপর প্রভাসের মতো করে নৌকোয় করে ফিরে এলেই হত। 

প্রভাস আমাদের মাঝে এসে দাঁড়াল। নোনাজলে ভেজা চুপচুপে গা। মুখে  বিজয়ীর হাসি। স্যার ওর দু কাঁধে হাত রেখে ঝাঁকিয়ে বললেন, সাবাস, প্রভাস! তারপর আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, এই হল প্রকৃত স্পোর্টসম্যান। ও পড়াশোনায় ভাল না হলে কী হবে, ওর কাছ থেকে তোমাদের অনেক কিছু শেখার আছে। 

প্রভাস পায়ে হাত দিয়ে স্যারকে প্রণাম করে উঠে দাঁড়াল। আমরা ওকে কোলে তুলে নিয়ে উল্লাসে ফেটে পড়লাম। ওই দলে নবীন আর অনন্তও সামিল হল। স্যারের কথাগুলো দুজনকে খুব অনুপ্রাণিত করেছে যেন! 

মাধ্যমিক পরীক্ষার পরের তিনটে মাস কী মজাতেই না কেটে গেল। রেজাল্ট বেরোল। কোনওরকমে পাশ করল প্রভাস। পরবর্তী শিক্ষা অর্জনের জন্য একে অপরের থেকে ছিন্ন হয়ে ছড়িয়ে পড়ার পালা শুরু হল আমাদের জীবনে। আমরা কজন কলকাতায় চলে এলাম। অনেকে মফস্বল টাউনগুলোয় ছড়িয়ে পড়ল। প্রভাসের মতো অধিকাংশই গ্রামের স্কুলেই থেকে গেল। বাইরের স্কুল কলেজে ভর্তি হওয়ার সাধ্যি ওর ছিল না। 

ছুটিছাটায় গ্রামে আসি। পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে গল্প আড্ডায় প্রাণ ভরে যায়। ফিরে যাওয়ার সময় প্রতিবারই প্রভাস খেয়াঘাটে আসে আমাকে বিদায় জানাতে। নৌকোয় উঠে দাঁড়াই, ও হাত নেড়ে বলে, আবার আসিস, অন্তু। আর আমার মনে পড়ে যেত, সেই প্রথম কলকাতায় যাওয়ার দিনটার কথা। ও ঠিক সময় ধরে খেয়াঘাটে আমার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিল। নৌকোয় উঠতে যাওয়ার আগে হাতে হাত মিলিয়ে দুজনে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। ওর চোখে জল। আমি অনেক কষ্টে নিজেকে সংবরণ করি। ও অস্ফুটে বলল, ছুটিছাটা পড়লেই চলে আসবি, অন্তু। শহরে মাঠ ঘাট কিচ্ছু নেই, ওখানে তোর মন বেশিদিন টিকবে কেন! 

আমি বুঝেছিলাম, আমার সান্নিধ্যের অভাব ওকে খুব কষ্ট দেবে। সেবার অনেক মাস পরেই গ্রামে এলাম। দেখি, আশু ময়রার মিষ্টির দোকানের ক্যাশ সামলাচ্ছে প্রভাস। আর আশুকাকু দোকানের বাইরে একটা চেয়ারে বসে পা দোলাচ্ছেন। আর এর ওর সঙ্গে ঠাট্টা মস্করা করছেন। ভারি দিলদরিয়া মানুষ এই আশুকাকু। ফুটবল অন্ত প্রাণ। গ্রামের কোনও ক্লাব শীল্ড বা ট্রফি জিতলে খেলোয়াড়দের পেট ভরে মিষ্টি খাওয়াবেন। বিজয় মিছিল বার করবেন, সবার আগে শিল্ড বা ট্রফি মাথায় নিয়ে আশুকাকু।

আমি অবাক হলাম। তাহলে কি প্রভাস পড়াশোনা ছেড়েই দিল! পায়ে পায়ে দোকানের সামনে এসে দাঁড়ালাম। আমায় দেখে ও কেমন কুঁকড়ে গেল যেন। চোখেমুখে দ্বিধা সংকোচ। অস্ফুটে জিজ্ঞেস করল, ভাল আছিস, অন্তু? শুনেছি তুই এসেছিস

ভাল আছি। তুই? 

এই তো দেখছিস, কেমন আছি! দীর্ঘশ্বাস ফেলল ও। 

পড়াশোনাটা কি তাহলে ছেড়ে দিলি? 

না ছাড়িনি। কলেজে ভর্তি হয়ে আছি। মাঝেমধ্যে যাই। বেশি রাত করে যতটুকু পারি পড়াশোনা করি। সংসার চালাতে হবে তো! 

কেন, তোর বাবা? 

বাবা তো নেই! বাকরুদ্ধ প্রায় ওর কন্ঠ। দুচোখে টসটসিয়ে উঠছে জল। বলল, শিবগঞ্জ বাজারে রামযাত্রা পালার আসরে বাঁশি বাজাতে বাজাতেই মাটিতে লুটিয়ে পড়ে বাবা। ওখানেই শেষ! 

আমার বুকটা কষ্টে মুচড়ে উঠল। ওর সমব্যথী হতে মনটা এখন আকুল। ওকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা আমার নেই। তবুও বললাম, একজন শিল্পীর এমন মৃত্যু গর্বের শুধু নয় মর্যাদারও। সন্তান হিসেবে তোরও বড় পাওয়া। 

সহসা ওর অশ্রুস্নাত দুটি চোখ কেমন চকচক করে উঠল। আলোময়  হয়ে উঠল মুখমণ্ডল। একটু হেসে আতিথেয়তায় সক্রিয় হয়ে উঠল। বলল, দুটো মিষ্টি খা, অন্তু। 

আমি বাধা দিয়ে বললাম, না, না। এই তো বাড়ি থেকে সকালের টিফিন করে সবে বেরোলাম

খাই না! ও নাছোড়বান্দা। জানি, আজ আমাকে শুধু জল নয় সেইসঙ্গে দুটো মিষ্টি খাওয়ানোর ক্ষমতা ওর হয়েছে। বুঝতেও পারছি, না খেলে বা খেয়ে দাম মেটাতে গেলে মনে খুব আঘাত পাবে। 

নিজের হাতে প্লেটে দুটো রসগোল্লা সাজিয়ে তাতে চামচ বসিয়ে ও আমার সামনে ধরল। আমি প্লেটটা হাতে নিতে ও চট করে দোকানের পেছন দিকটায় চলে গেল। ওখানে খাওয়ার জলের কল, ধোয়া গ্লাশ, প্লেট, চামচ রাখার জায়গা। আমি চামচ দিয়ে কেটে কেটে মিষ্টি খাচ্ছি। ও নিজের হাতে বড় এক গ্লাশ জল ভরে নিয়ে আমার সামনে এসে দাঁড়াল। মিষ্টিটা খেয়ে গ্লাশের  জলটা এক নিশ্বাসে শেষ করলাম। বড় তৃপ্তি বোধ করছি। এই তৃপ্তিবোধ ওর ভালবাসার, গভীর বন্ধুবাৎসল্যের। মনে স্মৃতি জাগল। জিজ্ঞেস করলাম, তোর বাবার পুরস্কার পাওয়া সেই গ্লাস দুটো এখনও আছে? 

আছে। উৎফুল্ল কন্ঠে বলল ও। 

তোর বাবার স্মৃতি। যত্ন করে রেখেছিস তাহলে, ভাল। আমি ওর প্রশংসা করি। 

ও দুটোর একটা তোরও স্মৃতি। তোরঙ্গে তুলে রাখা আছে। 

আমার! অবাক  হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ওটা আমার স্মৃতি হতে যাবে কেন? 

হ্যাঁ, তোরও। ও আন্তরিক গলায় বলল, ওটাতে তুই জল খেয়েছিলি না! 

আমি  বিস্মিত হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকি। আজও ও ওই দিনটার কথা ভোলেনি! যেদিন ওদের ভাড়াবাড়িতে আমি প্রথম গিয়েছিলাম ও আতিথেয়তা করতে ওর বাবার পুরস্কার পাওয়া কাচের গ্লাসে করে ঠান্ডা জল খাইয়েছিল! 

ওর ঠোঁটের বাঁকে খাদহীন অনাবিল বন্ধুত্বের হাসি এখন  যা কোনও দিন আমার মন থেকে মুছে যাওয়ার নয়!