সেজ মামার ঘরে আমার বিছানা। বাড়ির পিছনের দিকের ঘর। কেউ এ ঘরে বেশি ঢোকে না। অন্য ঘরে খাট, আলমারি, চেয়ার, সোফা আলনা যেমন থাকে তেমনি আছে। কিন্তু সব ঘরের থেকে আলাদা এ এক অদ্ভুত ঘর। ঢুকলে মনে হবে এ ঘরে কেউ থাকে না।
ব্যাপারটা মোটেই তা নয়। লম্বাটে ঘরে দু কোনায় দুটো জলচৌকি। বাগানের দিকে একটা বড় জানালা। দুটো ছোট কাঠের টেবিল। তার পায়া গুলো বার্নিশ উঠে যাওয়া। ছোট মামার আদরের বেড়ালের নখে আঁচড়ানো সাদা ছিট ছিট।
টেবিলের ওপরেও ধুলো জমে যাওয়া ছোপ ছোপ প্লাস্টিক শিট। দুটো জলচৌকিতে খেয়ে যাওয়া পাতলা ছেঁড়া তোষক। ঘরের দু কোণায় দুটো কাঠের ভাঙ্গা আলমারি। ধুলো মাখা কাঁচ ভাঙা। ভিতরে ধুলোমাখা বই ঠাসা, মাথায় গাদা গাদা খাতা, কাগজ। সব ধুলোয় মাখামাখি। খাটের বালিশের ওপরে, দেয়ালের ধারে গাদা খুচরো অঙ্ক করা খুচরো কাগজ। কখনো কখনো সকাল সকাল ঘুম ভেঙে গেলে শুয়ে শুয়ে খাতার পাতা ভরায়। কি যে লেখে কে জানে। কখনো নানা সিম্বলে, নানা লিমিটে ভর্তি। ঘরে ধুলোর একটা আস্তরণ পড়ে মলিন হয়ে আছে। মা মাসি দিদিমার কারুর সাধ্য নেই গুছিয়ে ভদ্র করে। ঘর ভর্তি কাগজে কোথাও কেউ একটু ছুঁয়ে দিলেই সেজ মামা খড়গ হস্ত। মামা বাড়িতে বকা খায়। বকা খায় কলেজে ছাত্র শিক্ষক প্রায় সবার কাছে। কিন্তু গায়ে মাখে না। মন তো পড়ে আছে অন্য কোথাও, অন্য কোনোখানে। অঙ্কের গোলক ধাঁধায়। অর্ধেক ক্লাস ঠিকমত নেয় না। প্রিন্সিপাল অনেকবার এই ক্লাস ফাঁকির জন্যে বকাঝকা করেছেন। বড় মামার প্রচণ্ড বকাবকিতে কলেজটা আজকাল রোজ যাচ্ছে। প্রিন্সিপাল বড় মামার বন্ধু। তাই খবরটা ঠিক চলে আসে। ছাত্র দের কোর্স শেষ না হলে চলবে না। বাড়িতে রোজ কিছু না কিছু নিয়ে হইচই। কাজের লোক ঘর মুছলেই অশান্তি। দিদিমা কে সেই ছোট বেলার মত চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে নালিশ। উনি নাকি কিছুই খুঁজে পাচ্ছেন না। সব নাকি হারিয়ে গেছে। এত অগোছালো কিন্তু তার মনের মধ্যে সাজানো আছে। তাকে খুঁজতে হয় না কোন কাগজের পর কোন কাগজ।
সেদিন দিদিমার একটু বাড়াবাড়ি হাঁপানি চলছে। সেজমামা দিদিমার পাশে বসে তার ঘরে। মাঝ রাতে বাথরুমে যেতে হবে। ঘুম ভেঙে উঠে দেখি নীল আলোয় মাখামাখি হয়ে গেঞ্জি আর লুঙ্গি পরা একটা রোগা মানুষ খালি মাটির দিকে তাকিয়ে নমস্কার করছে। ভাবলাম সেজ মামার মাথাটা কিছুটা খারাপ ছিলই তাহলে কি পুরোটাই গেল? চোখ কচলে ধাতস্থ হয়ে উঠে বসতে দেখেই পায়জামা গেঞ্জি পড়া উসখো খুস্কো মানুষ টা এক মুখ দাড়ি নিয়ে মুখ ভেংচে বললে “বুদ্ধি আর হবে কি করে? তাকিয়ে দেখি ঘরময় মামার পাতার পর পাতা অঙ্ক করা কাগজ গুলো ফরফর করে উড়ছে। লোকটার পায়ে লাগছে আর নমস্কার করছে। জোরে বললাম “কে, কে তুমি? এত কাগজ মাটিতে কেন?
আর বল না। টেবিলে রাখা জলের গ্লাসটা তুলে জল খেতে গিয়েছিলাম। ব্যস একেবারে বিশ্রী ব্যাপার। নীচে কাগজগুলো চাপা ছিল। ব্যস ফর ফর করে উড়তে লাগল। আর পায়ের তলায় লেখা কাগজ পড়লে নমঃ করতে হয়।
খালি বলছে এ কোথায় এসে পড়লাম রে বাবা! এতো বাজে কাগজের আস্তাকুড়ে। আমার দিকে চোখ পড়তেই একটু সতর্ক হল।
আমি তেরো, ও তেত্রিশ। অসম লড়াই হয় কখনো? বালিশ চাদর সরিয়ে ওর জামার খুঁট চেপে ধরে মামা, মামা, করে উদভ্রান্তের মত চিৎকার করছি। কোথায় মামা? থানার দারোগা চলে আসবে চিৎকারে কিন্তু মামার কোনো সাড়া নেই।
মামা দিদিমার ঘরে। চোর বললে এত রাতে চেচাচ্ছ কেন ?
তুমি সব নিয়ে যাচ্ছ আর আমি বসে থাকব? চেঁচাবো একশোবার।
চোর বললে চেঁচাবে বৈকি। এক মিনিট বাথরুম থেকে আসি? বলে ফুড়ুৎ করে বাথরুমে ঢুকে গেল। আমারও সাহস ফিরে এল। সে-জ-মা-মা চো ও ওর, তাড়াতাড়ি এসো। দুবার গলা ফাটাতেই…
কোথায়?, কোথায়? করতে করতে চেঁচিয়ে পাড়া মাত করে উঠোন পেরিয়ে ছুটে এল। দেখি হাতে একটা ফুল ঝাড়ু। আর সে সেই যে আমাকে দাঁড় করিয়ে বাথরুমে গেল আর ফিরে এল না। বসেই আছি, বসেই আছি কিন্তু দরজা খুলল না। বড় মামা চোখ কচলাতে কচলাতে চলে এল। কৈ, কৈ চোর কৈ।
শেষে ধাক্কাধাক্কিতে ছিটকিনি ভেঙে মামা বললে যা হবার তাই হয়েছে। চোর পালিয়েছে জানলা দিয়ে। বাথরুমের দুটো শিক নেই, হতেই পারে। সেজমামা উদ্বিগ্ন হয়ে আলো জ্বালিয়ে তক্তপোশে বাবু হয়ে বসে গালে হাত দিয়ে কাঁদো কাঁদো হয়ে বললে “কি হবে? আমার ইন্টারন্যাশনাল পেপার নিয়ে গেল। দুদিন বাদে পাঠাতে হবে আমেরিকায়। আবার আমাকে অঙ্ক করতে বসতে হবে।
অসহায় হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম “সবতো এলো মেলো হয়ে গেছে এখন সব ঘর ভর্তি কাগজ খুঁজে দেখব কি নিয়ে গেছে?”
কুঁই, কুঁই করে মামার উত্তর “তাহলে তো সকাল গড়িয়ে দুপুর।”
বললাম “ওর বয়েই গেছে ওই তোমার হাবি যাবি সব অঙ্ক করা পাতা নিতে। ওর কোনো দাম নেই ওর কাছে। বিক্রি করলে কোনো দাম পাবে না। আজ খুব জব্দ হয়েছে। কিছুই নেবার নেই। সেজ মামা মাটি থেকে কাগজ তুলতে তুলতে বললে” আহা, এটা দেখলি না যে ওর আজ উনুনে কিছু চড়বে কিনা?
মামার যেটা আছে সেটা আবার চুরি করা যায় না। দিদিমা যত্ন করে লোহার ট্রাংক এ রেখে দিয়েছে। ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটির থেওরেটিকাল ফিজিক্স এর একটা সামান্য ডি এস সি ডিগ্রি সার্টিফিকেট। কিন্তু ওতে টাকা পয়সা আসেনা। বরং অর্জন করতে পুরোটা নাহোক কিছুটা আধ পাগলা হতেই হয়। দিদিমা প্রায় আফসোস করে কেন যে সেজ এর পড়াশুনা করতে গেল? মাথা তাই গেল। বড়মামা, মেজ মামা, বড় মাসি, দিদিমা সবাই সেজ মামা কে এক বড় সড় শিশুই ভাবে।
হুলুস্থুল শেষ হলে সেজ মামা আলো জ্বেলে কাগজ খুঁজতে লাগল। কোন পাতার পর কোন পাতা। বড় মামা চলেই যাচ্ছিল। হঠাৎ ঘুরে দাড়িয়ে বললে “সেজ কুঁই, কুঁই করে কে কাঁদে রে। কার এত দুঃখ? কুকুর না বেড়াল? “সেজ মামার কাগজ খোঁজা থামিয়ে একটু শুনলে। তারপর দেখি গুটি গুটি বাথরুমের দিকে যাচ্ছে। রহস্যের গন্ধ আসছে। আমি ঘুম ছেড়ে সেজ মামার পিছু। চারিদিকে শ্যাওলা পড়া মেঝে। মাঝ খানে পায়খানা অবধি যাওয়ার পথ ওইটুকু শুধু শ্যাওলা বিহীন। সেজ মামা পা টিপে টিপে জানলার সামনে গিয়ে শিক ছাড়া জানলার বাইরে মুখ বাড়ালে। আমি দম বন্ধ করে কিছু একটা আবিষ্কারের মুখে। সেজ মামা বললে টর্চ দে। এক দৌড়ে ঘর থেকে টর্চ এনে দিলাম। সেজ মামা টর্চ ফেললে। আমি পিছন থেকে মামার মুখের দিকে। বড় মামা চেঁচাচ্ছে কীরে কি হল? কোথাও কিছু পেলি?
পিছন ফিরে সেজ মামা চুপি চুপি আসতে হাত নেড়ে ডাকল।
গিয়ে দেখি ওমা? একে? এখানে কি করছে? মামা বললে “কে তুই? এখানে কি?” কুঁকিয়ে কুঁকিয়ে অন্ধকারের নীচ থেকে উত্তর এল “বাবু আমি”।
“আমি কে?”
চুরি করতে নেমে বোধহয় নাম বলা বারণ। বললে “আজ্ঞে আপনাদের বাড়ী থেকে বেরিয়ে জানলা দিয়ে নীচে পড়ে পালিয়ে যাবো ভেবেছিলাম। কিন্তু পালায় কার সাধ্য? পড়লাম আর এক বোম আছাড় খেলাম। আছাড় খেয়ে কোমরটা বোধহয় গেছে। আর্তনাতের মত বললে “উঠতেই পারছিনা”।
আরে জলজ্যান্ত চোর বাবাজি যে। মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল “বেশ হয়েছে”।
সেজ মামা বললে “চিত্ত, আহত বাঘ কেও মারতে নেই। ওটা এথিক্স এর বাইরে। কেউ বিপদে পড়লে আগে সাহায্য, পরে বিচার।” বড় মামা শুনে গজগজ করতে লাগল। ওপর থেকে ছোট মামা কে ডাকা হল। তিনজনে মিলে চ্যাংদোলা করে সেজ মামার বিছানায় তাকে ফেলা হল।
সে তো বেচারি যন্ত্রনায় কাতরাচ্ছে। তার মধ্যেই খানিক বিরক্তি নিয়ে বলেই ফেললে “আপনাদের বাথরমেই পড়ে যাচ্ছিলাম। এরকম কেউ করে রাখে? উঠোনে আর বাথরুমে ভেজা থাকলে তো পার হওয়াই মুশকিল।
সেজ মামা চোখ নাচিয়ে বললে “পালাবে কোথায়? পদে পদে বিপদ পাতা আছে।” দেখি দেখি বলে কোমরে, পায়ে টিপে দেখতে লাগল।
কাঁদো কাঁদো গলায় বললে “বাথরুম আর উঠোন টা তো একটু পরিস্কার করান। কি শ্যাওলা, কি শ্যাওলা। এক ফোঁটা জল পড়লে ওটা তো এক মরণ ফাঁদ। নাহলে........”।
ছোট মামা বললে” কথাটা ঠিক। শ্যাওলা টায় পা পিছলে চিত্ত পড়লে তো মা আমাদের পিঠে চেলা কাঠ ভাঙবে।
আমিও দু চারবার পড়েছি সেই ভয়ানক বাথরুমে। কিন্তু বাড়িতে বাইরে জানাইনি। জানলে বাবা মামাবাড়ি আসা বন্ধ করে দেবে। তবে এখন অনেক ধাতস্থ।
সেজ মামার চোরের শারীরিক পরীক্ষা দেখে আমি ছোট মামা, বড় মামা চমৎকৃত। এক বার টিপছে আর বলছে এখানে?, এখানে? সব টিপে দেখে বললে “লেগেছে তবে ভাঙ্গেনি। হাত বোলাতে বোলাতে অ্যাসিস্ট্যান্ট কে অর্ডার করলে” চিত্ত ভোলিনি স্প্রে টা আর মেডিক্যাল বক্স টা নিয়ে আয় কুইক”।
বড় মামা এই দুর্যোগের মধ্যেও টিপ্পনী কেটে যাচ্ছে। “বাবার তোকে ডাক্তার করবার সখ ছিল। এখন দেখছি হলে কিন্তু বেশ মানাতো।”
চোর বলেই যাচ্ছে “স্যার আমি হরিপদ। প্লীজ জেলে দেবেন না। কিছুই তো নেই নি। বামাল শুদ্ধু তো ধরেন নি।”
সেজমামা এবার অন্য মানুষ। গর্জে উঠল চুপ। কোনো কথা নয়। তুমি আমার এক্তিয়ারে ঢুঁকেছ। সেটাই ক্রাইম। তুমি এখন রুগী। নেক্সট অর্ডার “ছোট যা একটু দুধ গরম করে আন তো”।
চোর বেচারা নড়তে পারছে না। মাঝ রাতে সেজ মামার সেবার কমতি নেই।
রীতিমত কাটা জায়গায় মলম লাগিয়ে। দুধ খাইয়ে সকাল হলে রিক্সা ডেকে আগাম টাকা দিয়ে তাকে বাড়ি পাঠানো হল। সেতো যাবার কি বলবে বুঝেই উঠতে পারলো না। লজ্জায় ধন্যবাদ ও বলতে পারলো না। যাবার সময় দেখি সেজ মামা কি একটা পকেটে গুঁজে দিচ্ছে।
বললাম কি দিলে?
বললো “কটা প্যারাসিটামল আর ওর তো দিন আনি দিন খাই। আমাদের এখানে এসে শুধুই লস। কিছুতো পেল না উল্টে কোমর পা হাত ব্যাথা লাগল। তাই কিছু খাবার জন্যে দিলাম”। আমি অবাক। এমন হয় নাকি?
বড় মামা হেসে বললে “সেজ তুই এত করলি কেন? ও তো সামান্য চোর”।
সেজ মামা একটু চুপ থেকে স্বগত ভাবে বললে “অসুস্থ রুগী, কি তার পেশা সেটার বিচার্য নয়। তার সেবা করাটাই সবার আগে। এটাই মানব ধর্ম। আর আমি এটা মানি”।
বড় মামা বেমক্কা এত ভারী কথায় কিছুটা হতচকিত হয়ে গেল। তারপর যেতে যেতে উচ্চ স্বরে বললো “ওয়েল ডান সেজ। সকাল হলে সেজর জন্যে হারুর দোকান থেকে ছয়টা জিলাপী আনিস চিত্ত। দুটো আমাকে আর তোর দুটো রাখিস। ছোট পাবে না ওর সুগার”। ছোট মামা মুখ ভেংচে নিজের ঘরে চলে গেল।