অনুভব স্কুল থেকে ফিরে ব্যাগটা বিছানায় ছুঁড়ে দিয়ে স্কুলের ইউনিফর্ম খুলতে খুলতে মাকে বলল, ‘মা আমি বেরুলাম মাঠে বন্ধুরা অপেক্ষা করে আছে।’ মা বেশ বিরক্তির সুরে বলল, ‘স্কুল থেকে ফিরে শুধুই মাঠে যাওয়ার তাড়া তোর, হাত মুখ ধুয়ে কিছু খেয়ে নে। তারপরে যাবি’ অনুভব বলল, ‘মা আজকে অনেক দেরি হয়ে গেছে, আজকে একটা ম্যাচ আছে তো। না গেলে প্রেস্টিজ থাকবেনা।’ ছেলেকে আটকানোর সাধ্য তার মায়ের নেই। অনুভব জামাটা বদলে বেরিয়ে গেল।
যখন ফিরল তখন সন্ধ্যা গড়িয়ে চারপাশে বেশ অন্ধকার হয়ে এসেছে। রাস্তার স্ট্রিট লাইট গুলো জ্বলে উঠেছে। হঠাৎ অনুভব লক্ষ্য করল, পাড়ার মোড়ের তেলেভাজার দোকানটায় অসম্ভব রকম ভিড়। কোন কিছু একটা অশুভ মনে ইঙ্গিত পেয়ে সে দোকানে উঁকি দিয়ে দেখলো দুইজন বাইরের লোক দোকানদারের সাথে অসভ্য ভাষায় ঝগড়া করছে। ব্যাপারটা মনঃপুত হল না অনুভবের। সে জিজ্ঞাসা করল, কি হয়েছে কাকু?
কিন্তু তার প্রশ্নের কেউ উত্তর দিল না। অনেকেই জটলা পাকিয়েছে ঘটনাটা জানার জন্য। অনেকে আবার এসব দেখে মজা নিচ্ছে। অনুভবের সাথে তার বন্ধু রুদ্র ছিল সে বলল, ‘অনুভব অনেক দেরি হয়ে গেছে। এখানে আর থাকা যায় না। বাড়িতে মা বকবে, চল আমরা যাই’। কিন্তু অনুভবের ব্যাপারটা ঠিক লাগলো না। এই পাড়ার দোকানে সে অনেকবার এসে খেয়ে গেছে। এদের মিষ্টিটা দারুন করে, বিশেষ করে লেডিক্যানি। ভদ্রলোকের ব্যবহারটাও অমাইক। কোনদিন কারো সাথে উচ্চস্বরে কথা বলে না। কি এমন হলো যে এদের সাথে এরকম ঝামেলা হচ্ছে। তার মনে কেউরিসিটি জেগে উঠেছে। আবার রাগও লাগলো লোকগুলোর প্রতি। একমাত্র সেই প্রতিবাদ করে উঠলো, ‘আপনারা এভাবে কাকুর সাথে ঝগড়া করছেন কেন?’ তখন একজন লোক তাকে লক্ষ্য করে বলল, ‘তুই কে ছোকরা আমাদের মধ্যে আসবি না চলে যা’, অনুভব এবার খানিক উত্তেজিত হয়ে পড়েছে। সে বলল, ‘আপনি আমাদের পাড়ায় এসে অহেতু ঝামেলা করবেন আর আমরা সহ্য করব, এ হয়না।’ লোকটি এবার বেশি বিরক্তির সুরে বলল, ‘তোমাদের পাড়ায় এরকম দু’নম্বরী কাজ হয় আমরা তো কেউ জানতাম না, ঝামেলা করছি কি আর সাধে। দোকানদারকে জিজ্ঞেস করো’। অনুভব দোকানের কাকুকে জিজ্ঞেস করল, ‘কি হয়েছে কাকু বলুন আমাকে’। দোকানদার বেশ আমতা আমতা করে বলল, ‘এনারা নানারকম অর্ডার করে খেয়ে এখন বলছে টাকা নেই। পরে দিয়ে যাব। আমি বললাম বাবু আমরা গরিব মানুষ এভাবে ধার রাখতে পারি না। তাতে এনারা রেগে গিয়ে এরকম ঝামেলা শুরু করেছে। রুদ্র দূর থেকে সব কথাই শুনছিল। এবার সেও অনুভবের কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। বলল,’ সত্যি এসব মেনে নেওয়া যায় না’। ওদিকে লোকগুলো যখন বুঝল দোকানদারের পক্ষে অনেকেই তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে। তখন তারা ধীরে ধীরে সরে পড়ল। যাবার সময় শাসিয়ে গেল, ‘পরে এসে দেখে নেব’। ঝামেলাটা এত তাড়াতাড়ি মিটে যাবে কেউ ভাবতে পারেনি। তারপর, লোক গুলো চলে গেল। কিন্তু দোকানদারের মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ। অনুভব বলল,’ কাকু কত টাকা ওরা খেয়েছিল আমরা সবাই মিলে আপনার ওটা পুষিয়ে দিচ্ছি’। এই বলে অনুভব পকেট থেকে ১০০ টাকা বের করল, রুদ্র কিছু টাকা দিল এবং ওদের দেখাদেখি দু একজন কিছু মিলিয়ে পুরোটা পুষিয়ে দিল। দোকান কাকু দীর্ঘদিন ওদের পাড়ায় দোকান করে। সবারই পরিচিত দুঃখের সুখে সবাই পাশে থাকে। কিন্তু বিপদ হল তারপরের দিন।
সকালবেলা দোকান কাকু যখন দোকান খুলতে এসে দেখে রাত্রে কারা তার দোকানে ভাঙচুর করে গেছে। ভেতরের সব জিনিসপত্র লন্ডভন্ড হয়ে পড়ে আছে। এরকম হবে কেউ ভাবতেই পারেনি। সামান্য একটা ঘটনাকে কেন্দ্র করে কেউ এসে তার দোকানের উপরে হামলার চালাবে? দোকান কাকু রাস্তার মাঝে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করল। কথাটা ছড়াতে বেশি সময় লাগলো না।
নিত্যদিনের মতো স্কুল থেকে ফিরে অনুভব যখন মাঠে গেছে, মাঠে ওদের এটা নিয়েই আলোচনা চলল। সবাই প্লান করল, চল দোকান কাকুর কাছে যাই। সেদিন তারা খেলা স্থগিত রেখে দোকান কাকুর কাছে গেল। দোকান কাকু ওই দুষ্টু লোকগুলোকে চেনে না। ওরা বাইরে থেকে এসেছিল তাই তাদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না। আর ওরাই যে সে ভাঙচুর করেছে তার কোন নির্দিষ্ট প্রমাণ নেই। তাই সব কিছু নিজের ভাগ্যের পরিহাস বলে মেনে নিল। দোকান কাকুর চোখের জল দেখে অনুভব নিজেকে স্থির রাখতে পারল না। সেই বন্ধুদের সাথে প্ল্যান করলো। এভাবে চলতে পারে না। তারা সবাই মিলে দোকান কাকুর দোকানটা সাজিয়ে ফেলার কাজে লেগে পড়ল। সব বন্ধুরা জুটে গেল দোকানটা সাজানোর কাজে কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে দোকানটা আবার সেই নতুনের মত হয়ে গেল। রুদ্র পাশের কার্পেন্টার থেকে একটা বোর্ড বানিয়ে এনে দোকানের সামনে লাগিয়ে দিল। বেশ কিছু চেয়ার-টেবিল ভেঙে পড়েছিল। সেগুলো ফেলে দিয়ে নতুন চেয়ার টেবিল এনে দোকানটা ঝা চকচকে নতুন করে ফেলল। দোকান কাকুর চোখে মুখে কৃতজ্ঞতার ছাপ সুস্পষ্ট দেখা যায়। সে বলল, ‘বাবা তোমরা আমার যে উপকার করেছ কোনদিন সেটা ভুলতে পারবো না। কালকে তোমাদের জন্য আমার স্পেশাল ট্রিট থাকবে তোমরা সবাই এসো কিন্তু’। পাড়ার সবাই ছেলেদের এরকম কাজ দেখে ধন্য ধন্য করতে লাগলো। অনুভবের বাবা অফিস থেকে ফেরার সময় লক্ষ্য করেছিল, সেও তার ছেলের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। যাইহোক পাড়ার ছেলেরা যে মানুষের দুঃখ সুখে সব সময় পাশে থাকে এরকম একটা বার্তা পুরো পাড়াময় রটে গেছে। দোকান কাকু কিন্তু নিজের কথা রেখেছিল। সবাইকে পেট ভরে লেডিকেনি, আর সিঙ্গারা খাইয়েছিল। অনুভবের কিন্তু এটাতে মন ভরেনি। কতদিন ওই সব দুষ্টু লোকেরা এসে গরিব মানুষের উপর অত্যাচার করে যাবে এর একটা প্রতিবাদ করতে হবে। ওরা আজ নয়তো কাল এসে আবার দোকানে ভাঙচুর চালাতে পারে। ওইসব ক্রিমিনাল মানুষদের জেলের ভেতরে থাকা উচিত। তাই অনুভব আর তার বন্ধুরা থানায় গিয়ে হাজির হলো।
দোকান কাকু ভয়ে এফআইআর করতে রাজি হচ্ছিল না কিন্তু অনুভব তাদের পাশে থাকবে বলে সান্ত্বনা দিল এবং পুলিশের কাছে এফআইআর করিয়ে ফিরে এলো। পুলিশ যথাসাধ্য নিজের যথা সম্ভব চেষ্টা করেও যখন ওদের ধরতে পারল না। অবশেষে তারা হাল ছেড়ে দিয়েছে। এভাবে কোন ঘটনা অমীমাংসিত রয়ে যাবে অনুভব সেটা মেনে নিতে পারে না সে নিজের মতো করে ওই লোকগুলোর খোঁজ চালাতে লাগলো তার বন্ধুদের বলে দিয়েছে। যেখানেই দেখা পাবে যেন তাদের ঠিকানা সংগ্রহ করে নেয়। ওদের উপযুক্ত শাস্তি দিতেই হবে। এভাবে বেশ কয়েকদিন কেটে গেল।
নীল আকাশে তখন সাদা সাদা মেঘের আনাগোনা শুরু হয়েছে। শরতের পূর্বাভাসে চমৎকার একটা দিন। অনুভব তাদের বন্ধুদের সাথে মাঠে খেলা করছে হঠাৎ তাদের দৃষ্টি গেল রাস্তায় দুটো লোক এদিকেই যেন হেঁটে আসছে। অনুভব চিনতে একটুকো ভুল করেনি। হ্যাঁ এরা সেই লোক দুটো যারা দোকান কাকুর সাথে অসভ্য ব্যবহার করে তার দোকানটা ভেঙ্গে ফেলেছিল। এতদিন পরে এদের হাতের নাগালে পেয়েছে। আজ ছেড়ে দেওয়া যায় না। সে চুপি চুপি বন্ধুদের কানে কিছু বলল। বন্ধুরা ঘাড় হেলিয়ে সম্মতি প্রকাশ করল এবং সবাই লোক দুটোকে অনুসরণ করতে লাগলো। তারা দেখল, লোক দুটো বড় গলি পেরিয়ে একটা ট্রামে উঠে পড়েছে। অনুভব তাদের অনুসরণ করে সেই ট্রামে উপর উঠে বসল। লোক দুটো গড়িয়ায় নেমে একটু বাজারে ঘোরাঘুরি করে একটা ফ্লাটে ঢুকে পড়লো। ব্যাস আর কোন অসুবিধা নেই। তাদের ফ্ল্যাট নাম্বারটা একটা ডাইরির মধ্যে নোট করে নিয়ে তারা সেদিনের মতো ফিরে এলো। ওরা যে লোক দুটোর পিছনে স্পাই এর মত অনুসরণ করছিল লোক দুটো বুঝতে পারেনি।
এবারের ঘটনাটা খুব সামান্য সেই ঠিকানা নিয়ে যখন ওরা থানায় হাজির হলো, বড়বাবু ওদের কথামত দুটো পুলিশ কনস্টেবল নিয়ে দুষ্টুলোক দুটোকে ধরে আনলো। বড়বাবু বিষয়টা খুব সিরিয়াস নিয়ে দুষ্টুলোক দুটোর উপর প্রেসার দিলে ওরা ভীষণ ভয় পেয়ে যায়, পুলিশের কাছে বাধ্য হয়ে নিজেদের দোষ স্বীকার করে।
অনুভবের এই কীর্তি আবারো পাড়াময় ছড়িয়ে গেছে। এতদিন সবাই তাকে মানুষের পাশে থাকার জন্য স্নেহ করত কিন্তু এখন সে একটা খুদে ডিটেকটিভ এটা যেন পাড়ার লোকে মানতে শুরু করেছে। এবং বেশ সমীহ করে চলে। অনেকে তো নিজের বাড়ির ছোটখাটো ঘটনা হলে তার কাছে এসে আলোচনা করে। অনুভব ও তার বন্ধুরা চেষ্টা করে যথাসাধ্য তাদের সমস্যার সমাধান করে দিতে। অনুভব ছোট থেকে মানুষের দুঃখ সুখে পাশে থেকেছে, নিজের মতন করে তাদের সবার সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা করে গেছে ।
অনুভবের অনুভব থেকে এটাই বলা যায় বয়স যে একটা সংখ্যা মাত্র, ইচ্ছে থাকলে কম বয়সে সমাজের অনেক কল্যাণকর কাজে নিজেকে নিয়োজিত করতে পারে মানুষ। অনুভব যেন তার একটা জ্বলন্ত উদাহরণ।