রাগে চোখ মুখ লাল হয়ে
গেছে বিল্টুর। নাকের পাটা একবার করে ফুলছে আর চুপসে যাচ্ছে। ফোঁস ফোঁস করে
নিঃশ্বাসের শব্দ হচ্ছে। বুকটা একবার উঠছে একবার নামছে। হাত মুঠো করে দাঁড়িয়ে আছে বিল্টু।
তার এমন চেহারা দেখে একটু বোমকে গেল হাবুল। হাতের বাটিটা মাটিতে নামিয়ে এক পা দু'পা করে উঠোন পেরোতে গেলেই বিল্টু হেঁকে উঠল,
“ঠাকমা, ও ঠাকমা।”
ঘটনাটা তাহলে খোলসা করে
বলা যাক। একদিন স্কুল ছুটির পর বিল্টু বন্ধুদের সাথে ফুটবল খেলতে খেলতে বাড়ী
ফিরছিল। হঠাৎ হাবুল সাইকেলটা ব্রেক কোষল ওদের সামনে। হাবুল বিল্টুর জ্যাঠতুতো
দাদা। বিল্টুর থেকে দুক্লাস উপরে পড়ে। বিল্টুর সিক্স আর হাবুলের এইট। হাবুলের এহেন
আচরণ দেখে বিল্টু একটু খাপ্পা হয়ে বলল, “কি রে দাদা এখানে এভাবে ব্রেক মারলি যে?” হাবুল গম্ভীর হয়ে বলল, “ক্যারিয়ারে বোস। কথা আছে।” বিল্টু একটু অবাক
হলো। দাদা সাধারণত তাকে সাইকেলে চাপিয়ে বাড়ী নিয়ে যায় না। বন্ধুদের সাথে জটলা
বেঁধেই যায়। ওরা কি সব আলোচনা করে। বিল্টু কান পাততে গেলেই দাদা চোখ রাঙিয়ে দূরে
সরিয়ে দেয়। বড়দের কথা নাকি শুনতে নেই। দাদা বড় হয়ে গেছে? তবে যে এখনো জেঠিমা জেঠুর কাছে বকা খায়?
হাবলুর কথামতো বিল্টু উঠে
বসলো সাইকেলের ক্যারিয়ারে। হাবলু সাইকেলটা ঝড়ের বেগে উড়িয়ে নিয়ে গিয়ে থামল একটা
গুমঠির সামনে। তারপর বিল্টুকে একটা দশটাকা ধরিয়ে দিয়ে বলল, “যা তো একটা সিগারেট নিয়ে আয়। আমি ওই গাছটার
কোণে লুকিয়ে আছি।" বিল্টু তো আকাশ থেকে পড়ল, “আমি সিগারেট আনবো? বাবা, জ্যাঠা জানলে কিন্তু পিঠের ছাল তুলে নেবে।” হাবলু মুখ বেঁকিয়ে বলল, “এহ, সত্যবাদী যুধিষ্ঠির এলেন রে! বলবি কেন এই কথাটা?”
― আরে, ওই কাকুই তো বলে দেবে। আর আমিই ফাঁসব। তখন
কিন্তু আমি বলে দেবো দাদা তুই আমায় বলেছিস আনতে।
― ঠিক আছে বলিস। আমিও
কাকুকে বলে দেবো সেদিন টেবিলে কার হাত লেগে চা পরে কাগজপত্র গুলো নষ্ট হয়েছিল।
বিল্টুর হৃৎপিন্ড লাফিয়ে
উঠল। বাবার দরকারি কাগজে সেদিন তার ফুটবল লেগেই চা পরে গিয়েছিল। বাবা খুব ঝাড় খেয়েছিল অফিসে।
হাবলু এখানেই থামল না।
বলতে লাগল, “আর পরশু দুপুরে
ছাদে গিয়ে আচারের বয়াম থেকে কে আচার খেয়েছিল?” বিল্টুর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখা দিল। গলা
শুকিয়ে কাঠ। এগুলো দাদা বাড়িতে বলে দিলে তো কেলেঙ্কারি। একটাও পুরীর লাঠি আস্ত
থাকবে না। মা বাবা সবকটা তার পিঠেই ভাঙবে। হাবলুর হাত থেকে দশটাকার নোটটা ফস করে
টেনে নিয়ে বলল, “ঠিক আছে, ঠিক আছে। এনে দিচ্ছি। কিন্তু তোর রুমালটা দে।
মুখ বাঁধি আগে। কেস আমিও খেতে চাইনা।" হাবলু মুচকি হাসল। ওষুধে কাজ দিয়েছে।
এই এক ওষুধে অনেক গুলো কাজ করিয়ে নেওয়া যাবে এবার।
বিল্টু রুমালে নাক মুখ
বেঁধে গুমঠির কাকুকে টাকা দিয়ে বলল একটা সিগারেট দিতে। সেই লোক আবার পোর খাওয়া।
দেখেই বুঝতে পেরেছে ছেলে নতুন শিখছে। একটু খেলানোর জন্য বলল, “তা কি ব্র্যান্ড? কিং সাইজ না স্মল?" বিল্টু পড়ল বিপাকে। এসব আবার কি? এতো ধরণের সিগারেট হয় নাকি? বাবা জ্যাঠা তো যা খান সবই সাদা কাঠি। এদিকে
দাদা বলে দিয়েছে ভুল করেও যেন গাছতলার দিকে না তাকায়। বিল্টু মাথা চুলকে বলল,
“দাও না গো কাকু কিছু
একটা। যে পাঠিয়েছে সে এসব কিছু বলে দেয়নি।” দোকানদারের পেটের ভিতর তখন হাসি ভুরভুর
করছে। কিন্তু হাসতে পারছে না। আরেকটু মজা করলে হয়। এবার সে বলল, “তা গন্ধ ঢাকতেও তো কিছু চাই। পান বা চুইং গাম
দেবো নাকি?” বিল্টুর
এবার কাঁদো কাঁদো দশা। দাদা তো এসব কিছুই
বলে দেয়নি। তাকে এভাবে ফাঁপরে ফেলে গাছতলায় সাইকেলের সীটে পেছন লাগিয়ে বন্ধুদের
সাথে আড্ডা দিচ্ছে। বিল্টু এবার অধৈর্য হয়ে বলল, “আমি অতশত জানি না। যা আছে তাই দাও। যারা খাবে
তারা বুঝবে। আমার কাছে আর পয়সা নেই।” দোকানদার এবার ফিক করে হেসে ফেলে একটা সাদা
কাঠি এগিয়ে দিল। বিল্টু তড়িৎ গতিতে সেটা পকেটে চালান করে হাঁটতে শুরু করলো। হঠাৎ
শুনতে পেল দোকানদার কাকে যেন বলছে, “গৌরপাড়া হাই স্কুলের হেডস্যার আমার হাতের পান খেতে খুব ভালোবাসেন।” বিল্টু
একবার আগুন চোখে ঘুরে তাকিয়েই আবার হনহনিয়ে হাঁটা লাগল। উফফ, ব্ল্যাকমেলারে ছেয়ে গেল পৃথিবীটা।
সন্ধ্যেবেলা বীজগণিতের
সূত্রগুলো ব্যস্ত বিল্টু। একে তো নামতা মুখস্থ করতে নিজের নামটা ভুলে যায়। তার উপর
আবার এ, বি, সি, ডি স্কোয়ার। জীবনটা ফালা ফালা হয়ে গেল। তখনই গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো এসে
হাজির হলো হাবলু। দরজায় হুরকো তুলে চোখ রাঙিয়ে বলল, “আই, সকালে কি সিগারেট এনে দিলি? কেশে কেশে দম
হালকা হয়ে গেল সবার।” বিল্টু বিরক্ত হলো, “আমাকে বলে দিয়েছিলি কি আনতে হবে? যা পেয়েছি এনেছি।” হাবলু চোখ ছোট করে ঝুঁকে বলল, “এটার জন্য তোকে ফাইন দিতে হবে।” বিল্টু চোখ মুখ
কুঁচকালো, “বিকেল থেকে আমার
পেছনে পড়েছিস কেন বলতো? আমি পারবো না
কিছু করতে।" হাবলু বলল, “ও পারবি না। বেশ
তাহলে ঠাম্মাকে গিয়ে বলে আসছি।”
― কি বলবি তুই?
― ওই যে নিতাই জ্যাঠা আসার
দিন তিনটে রসগোল্লা কেন কম পড়েছিল।
বিল্টু এবার বাধ্য হয়ে
উঠে দাঁড়াল। আগের সপ্তাহে দূরসম্পর্কের আত্মীয় নিতাই জেঠুর আসার সুবাদে হরিদার
দোকানের গরম রসগোল্লা আর অমৃতি আনিয়ে রাখা হয়েছিল। বিল্টু সুযোগ বুঝে দুটো টপাটপ
মুখে পুড়ে উধাও হয়েগেছিল। পরে বাবা আর হরিদার মধ্যে বেশ একটা কাজিয়া হয়ে গেছিল। বাবা
বলেছিলেন হরিদা মিষ্টি কম দিয়েছে। হরিদাও মানতে চায় না। সেই সুবাদে এখন বাড়িতে হরি
ময়রার মিষ্টি আনাও বন্ধ হয়ে গেছে। হাবুলের কাছে গিয়ে গম্ভীর মুখে বলল, “বল কি করতে হবে?” হাবুল একগাল ফিচেল হাসি হেসে বলল, “বাবা অফিস থেকে এসেছে।”
― তো কি করবো?
― আহ, শোনই না। বাবার জামাটা আলনায় শুকোতে দেওয়া আছে।
তার বুক পকেটে অনেকগুলো খুচরো আছে। তুই সুযোগ বুঝে সেগুলো নিয়ে চলে আয়।
বিল্টু প্রবলভাবে মাথা
নেড়ে বলল, “না টাকা পয়সা
চুরি আমি করতে পারবো না।” হাবুল আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল এমনসময় দরজায় টোকা পড়ল।
বাইরে থেকে শোনা গেল সুদেষ্ণার কণ্ঠস্বর। সুদেষ্ণা বিল্টুর মা আর হাবুলের কাকিমা।
হাবুল তড়িঘড়ি গিয়ে দরজা খুলে দিতেই সুদেষ্ণা সন্দিগ্ধ চোখে বললেন, কি ব্যাপার দরজা বন্ধ ছিল কেন? হাবুল একগাল হেসে বলল, কিছু না গো কাকিমা। ভাইকে বীজগণিতের সূত্র
মুখস্থ করাচ্ছিলাম।
বলেই সে এক দৌড়ে পগার
পার। তার সন্দেহ তবু যায়না। তার ভাসুরের
ছেলেটি হাতে পায়ে চঞ্চল না হলেও মিচকে বদমাস। তার ওপর সদ্য কিশোর। কতো ধরণের
নিষিদ্ধ হাতছানি চারিদিকে। নিশ্চই কিছু ফন্দি আটছে দুজনে। ছেলের কাছে গিয়ে
দাঁড়ালেন তিনি। বিল্টু ঘাড় গোঁজ করে বসে আছে। বিছানায় বসে জিজ্ঞাসা করলেন, কি হয়েছে রে? হাবুল কি বলছিল? বিল্টু তেমনই ঘাড় গুঁজে বলল, কিছু না। বলল তো মুখস্থ করাচ্ছিল। সুদেষ্ণা
বুঝলেন এখন ছেলের মুখ থেকে একটা কথাও তিনি বের করতে পারবেন না। উঠে রান্নাঘরে চলে
গেলেন তিনি।
এদিকে হাবুলের অত্যাচার
দিনে দিনে বাড়তেই লাগল। ঘুরতে ফিরতে নানা ধরণের অন্যায় আব্দার করে বসে সে। বিল্টু
না বললে কোনো পূর্বকৃত কাজের ভয় দেখিয়ে তাকে দিয়ে কাজটা করিয়ে নেয়। এদিকে বাড়ীর
বড়রা কিছু একটা আন্দাজ করতে পারছেন। দুই ছেলের হাবভাব, স্বভাবে পরিবর্তন হচ্ছে। হাবলু হয়ে পড়ছে
বেপরোয়া আর বিল্টু নিজেকে গুটিয়ে ফেলছে সবার থেকে। হাবলুকে দেখলেই বিল্টু ভয়
পাচ্ছে বা রেগে যাচ্ছে। এদিকে হাবুলেরও মন খারাপ। স্কুলে বেনো জলের মতো এসে ঢুকেছে কিছু নতুন ছেলে। এরা
পড়াশোনায় মোটামুটি হলেও ওদের স্বভাব চরিত্রের জন্য আগের স্কুল থেকে বিতাড়িত হয়েছে।
কেন যে হেডস্যার এদের গৌরপাড়ার মতো নামজাদা স্কুলে নিলেন কে জানে? মন্দের মধ্যে হাবুল ওদের সাথে জড়িয়ে পড়ে
কয়েকবার সিগারেটে দিয়ে দিয়েছিল দুটো টান। তারপর থেকে ওদের সান্নিধ্য কিছুতেই
ছাড়াতে পারছিল না সে। ওরাও হাবুলের থেকে নানান জিনিষ আদায় করতে লাগল। না দিতে
পারলে ওর সিগারেট খাওয়ার কথা ওর বাড়িতে বলে দেওয়ার ভয় দেখাতো। হাবুল নিজের পিঠ
বাঁচাতে ছড়ি ঘোরাতে লাগল ছোট ভাইয়ের ওপর। কিন্তু ব্যাপারটা এবার একদম ভালো ঠেকছে
না। জল মাথার ওপর উঠে যাচ্ছে। ওদের চাহিদা দিনে দিনে বেড়েই যাচ্ছে। আর বিল্টুর
ওপরেও চাপ বাড়ছে। সামনেই পূজোর ছুটি। ছুটি পরে গেলেই ওদের থেকে দূরে থাকতে পারবে
হাবুল। তার আগে এই শেষ চাহিদাটা মিটিয়ে দিতে হবে। এই ভেবে সক্কাল সক্কাল বিল্টুকে
ধরার প্ল্যান করে প্যাডেলে চাপ দিয়ে টিউশন পড়তে গেল হাবুল।
হাবুল বেরোতেই হাঁফ ছেড়ে বাঁচল বিল্টু।
চুপিচুপি ছাদে এসে বসে তারা ভরা আকাশের দিকে চেয়ে ভাবতে লাগল দাদা হঠাৎ এরকম
পাল্টে গেল কেন? কেনই বা ওই বাজে
ছেলেগুলোর সাথে মিশছে দাদা। কতদিন বিল্টু কোন দুস্টুমি করেনি। কারুর গাছের ফল
পাড়তে যায়নি। বন্ধুদের সাথে খেলতে যায়নি। ঘুড়ি ওড়াতে যায়নি। এমনকি ভালো করে পড়ায়
মন বসাতেই পারছে না সে। তার চিন্তায় ছেদ পড়ল একটা গন্ধে। আহ! ডালের বড়া। পিছন ফিরে
দেখল হাতে এক বাটি মুড়ি চানাচুর আর গরম গরম ডালের বড়া হাতে দাঁড়িয়ে আছেন জেঠিমা।
ডালের বড়া বিল্টুর খুব প্রিয়। পারমিতা বিল্টুর পাশে বসে তার মাথায় হাত বোলালেন।
দেওরের ছেলে হলেও বিল্টু তার নিজের ছেলের থেকে কম কিছু না। সারাদিন ছেলেটার
দুস্টুমি সামলাতে আর তা বাড়ির ছেলেদের থেকে আড়াল করতেই কেটে যায় তার। সেই ছেলে
হঠাৎ এরকম চুপ মেরে যাওয়ায় সবারই খুব চিন্তা হচ্ছিল। বিল্টুও তার জেম্মাকে খুব
ভালোবাসে। মা'কে ভয়ে যা বলতে
পারে না তা জেঠিমাকে বলে সে। পারমিতা বিল্টুর মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, “কি ব্যাপার রে তোর? আমাকে বল।" বিল্টু যেন এই আশ্বাস বাণীর
জন্যই অপেক্ষা করছিল এতদিন। হাউমাউ করে কেঁদে সব বলে ফেলল। নিজের দোষ, দাদার কীর্তি সব সব। বিল্টুর চোখ নিজের আঁচলে
মুছিয়ে দিয়ে পারমিতা তাকে আদর করতে করতে বললেন, “পাগল ছেলে। এত কাঁদে নাকি? তুইও অন্যায় করেছিস, তোর দাদাও অন্যায় করেছে। কিন্তু তুই স্বীকার
করে নিয়েছিস তাই তোর শাস্তি কম হবে। তোর দাদা যেটা করেছে সেটা বড় অন্যায়। সে
স্বীকারও করেনি। তাই শাস্তিও বড় পাবে। শোন, আবার যদি....” বলেই বিল্টুর কানে একটা কিছু
ফিসফিস করে বললেন। বিল্টু হাসি মুখে ঘাড় নেড়ে খেতে শুরু করল। পারমিতা উঠে গেলেন।
সিঁড়ির মাঝে দাঁড়িয়ে ছিলেন সুদেষ্ণা। দিদি আসছে দেখে সতর্ক হয়ে ইশারায় জিজ্ঞেস
করলেন, সব ঠিক আছে তো? পারমিতাও ইশারায় আশ্বস্ত করে নীচে নামার জন্য
বললেন। নীচে নেমেই সব বলবেন।
সকালে প্ল্যানমাফিক
বিল্টুকে বারান্দায় বসে থাকতে দেখে হাবুল সামনে এসে দাঁড়াল। বিল্টু বিরক্তির চোখে
একবার দাদার দিকে তাকিয়ে আবার মাথা নীচু করে ব্যাগ গোছাতে লাগল। হাবুল পা নাচিয়ে,
দুলে দুলে বলল, “তোর খাওয়া হয়ে গেছে?” বিল্টু মাথা নীচু করেই বলল, “তোর যখন হয়নি আমারও তখন হয়নি।” হাবুল এবার উবু
হয়ে বসল, “ভালো। শোন,
মা কাকিমা যখন খেতে দেবে
তখন রান্না ঘরে গিয়ে পাঁচটা মাছ ভাজা টিফিন বক্সে ভরে নিবি। তারপর টিফিন পিরিয়ডে
আমায় দিয়ে দিবি।” বলেই বারান্দায় নামানো এক বাটি আলু চচ্চড়ি নিয়ে খেতে শুরু করল।
বিল্টু একবার হাবুলের মুখের দিকে তাকিয়ে আবার অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, “পারবো না।” হাবুল এই কথায় লাফিয়ে উঠল, “কি পারবি না? ঠিক আছে। ঠাকুমাকে বলে দিচ্ছি তুই একদিন পানের
ডিবে থেকে পান চুরি করে খেয়েছিস।" বিল্টুও এবার উঠে দাঁড়াল। সর্বশক্তি দিয়ে
চিৎকার করে বলে উঠল, “তুই কি বলবি আমিই
বলবো। সব বলবো। যা শাস্তি পাওয়ার আছে পাবো। কোনো ভয় নেই আমার। হাবুল দেখল রাগে চোখ
মুখ লাল হয়ে গেছে বিল্টুর। নাকের পাটা একবার করে ফুলছে আর চুপসে যাচ্ছে। ফোঁস ফোঁস
করে নিঃশ্বাসের শব্দ হচ্ছে। বুকটা একবার উঠছে নামছে। হাত মুঠো করে দাঁড়িয়ে আছে সে।
তার এমন চেহারা দেখে একটু বোমকে গেল হাবুল। হাতের বাটিটা মাটিতে নামিয়ে এক পা দু'পা করে উঠোন পেরোতে গেলেই বিল্টু হেঁকে উঠল,
“ঠাকমা, ও ঠাকমা।” ভেতর থেকে বিন্দু দেবী, পারমিতা, সুদেষ্ণা একে একে এসে দাঁড়ালেন। হাবুলের গলা
শুকিয়ে এলো। ভাইটা হঠাৎ এরকম পাল্টে গেল কেন? বিল্টু এদিকে গড়গড় করে সব বলতে শুরু করেছে।
দোতলা থেকে মুখ বের করে শুনছে হাবুলের কাকা। তাই দেখে হাবুলের পেটের মধ্যে উথাল
পাথাল শুরু হয়েছে। এ ছেলের আজ হলো কি? কেমন কেসটা খাইয়ে দিল! সব ওই বখাটে ছেলে গুলোর কাজ। ওদের সাথে না মিশলেই হতো।
অনিমেষ এদিকে নেমে এসেছেন। হাতে পুরী থেকে কেনা দুটো লাঠি। আজ দুই ছেলের পিঠ ভাঙা
হবে। হাবুলের মাথা ঘুরতে লাগল। কি কুক্ষণে আজ কাকা অফিস যায়নি। হাবুল আমতা আমতা
করে বলল, “এই তো এটাই
চাইছিলাম ভাই। তোর সৎ সাহসের উদ্রেক করতে চেয়েছিলাম। এই দেখ তুই কেমন সব দোষ
স্বীকার করে নিলি। ভেরি গুড।" পারমিতা হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন, “তোর এখনো লজ্জা নেই রে হাবুল?" হাবুল মাথা নিচু করে দাঁড়াল। আজ তাকে কেউ রক্ষা
করতে পারবে না। মাও সব জেনে গেছে। এটাই হওয়ার ছিল। অনিমেষ নিচে নেমেই প্রথম ঘা
দিলেন বিল্টুর পিঠে। তার আগেই পারমিতা হ্যাঁচকা টানে তাকে সরিয়ে নিলেন। বেশ একটা
শোরগোল শুরু হলো দেওর বৌদির মধ্যে। সুদেষ্ণা দুজনকে থামাতে উদ্যত হলেন। বিন্দুদেবী
ছোট নাতিকে বুকে জড়িয়ে বসে রইলেন। আহা গো, ছেলেটার ওপর থেকে যেন পাথর সরল একটা। শেষমেষ পারমিতা একখানা লাঠি উঁচিয়ে বললেন,
“সব দোষ ওই হাবুলের। মার
খেলে ও খাবে।" কিন্তু কোথায় হাবুল সে ততক্ষণে সাইকেল আর ব্যাগ নিয়ে স্কুলের
দিকে ছুটেছে। আজ সেও একটা হেস্তনেস্ত করে বাড়ি ফিরবে। তারপর যা থাকে কপালে। এসব
ব্ল্যাকমেইলিং এর চক্করে সে আর থাকবে না।
বিল্টু সেদিন আর স্কুল
গেল না। আজ তার মন বেশ ফুরফুরে। ঠাকুমা নিজে হাতে করে নাড়ু, আচার, মোয়া দিয়ে বসিয়ে দিয়েছেন তাকে দালানে। জেঠিমা চ্যালা কাঠ রেডি করে রেখেছেন
দাদার জন্য। দাদাকে বিকেলে বাঁচাতে হবে। যতই হোক তার একমাত্র দাদা বলে কথা। তবে
একটা কথা বেশ বুঝতে পারছে হাবুল, অন্যায় করে
স্বীকার করে নিলে আর সত্যি কথা বললে বেশ হালকা লাগে মনটা।