শ্রদ্ধেয় কবি ভবানীপ্রসাদ
মজুমদার মহাশয়কে নিয়ে লিখতে গেলে আমার প্রয়াত পিতার কথা একটু হলেও লিখতে হবেই। কেন
সেটা বলি। শৈশবে গ্রামে থাকাকালীন দেখতাম আমার বাবা (বর্তমানে প্রয়াত) কাজী আবু
আতাহার সাহেব মাসিক শুকতারা পত্রিকা কিনে আনতেন আসানসোল গেলেই। আমি তখন সম্ভবত
ক্লাস ফাইভ বা সিক্সে পড়ি। বাবা আমাকে প্রথম ‘বাঁটুল দি
গ্রেট’ ও ‘হাঁদা ভোঁদা’ কমিকস পড়িয়েছিলেন এবং ছবির চরিত্রের কে কোন বাক্য আগে পরে বলছে তাও
হাতেকলমে বেশ কয়েকবার দেখিয়ে শিখিয়েছিলেন। পরে শুকাতারা পত্রিকার বাকি সব বিভাগের
প্রতি আকৃষ্ট হয়ে গল্প-ছড়া-ধাঁধা ছাড়াও অন্য পত্রিকায় শব্দজব্দ-সহ কত কিছু
শিখেছিলাম বাবার কাছেই। সত্যি বলতে কি, বাবাই আমার বুকে
প্রথম সাহিত্যপ্রেমের প্রদীপ জ্বেলেছিলেন। তবে এটাও বলতেন, ‘স্কুলের
পড়ার পরে সময় পেলে গল্পের বই পোড়ো। তাতে যেমন বহু কিছু জানতে পারবে, শিখতে পারবে, তেমনি নির্মল আনন্দও পাবে।’
১৯৯২ সালে আমি দস্তুরমতো
সাবালক, চাকরিও করি। বড়োদের গল্প পড়ার নেশাও যেমন, তেমনই শিশুকিশোর সাহিত্য পড়াতেও। তখন ‘দৈনিক ওভারল্যান্ড’
নামের একটি কাগজ আসত আমাদের বাড়িতে। ওই কাগজে সপ্তাহে একদিন
(বুধবার) শিশুকিশোরদের জন্য একটি পাতা বরাদ্দ ছিল। ‘সোনার
কাঠি’ নামের ওই পাতায় পাঠকদের চিঠির উত্তর সুন্দর ছন্দে
দিতেন বিভাগীয় পরিচালক, নাম ‘সবুজবুড়ো’। কারও ছদ্মনাম, তা বুঝতে
বাকি ছিল না আমার। তবে সেটা জানতাম বা তখন। অনেক পরে জেনেছিলাম পাণ্ডবেশ্বরের
অম্বিকা মণ্ডল-দার কাছ থেকে। আজ উনি নেই, কিন্তু উনিও আমাকে
লেখার প্রেরণা দিতেন বলেই তাঁকে স্মরণ করলাম।
তা যে-কথা বলছিলাম, বড়ো মধুর ছিল ভবানীদার (সবুজবুড়ো নামেই) পাঠকের প্রশ্নের
ছন্দে উত্তর দেওয়াটা। উত্তরে প্রিয়প্রতিম দিয়ে এমন মিষ্টি করে পত্রলেখকের নাম-সহ
ছন্দে উত্তর দিতেন তিনি, যা বার কয়েক পড়ে মনে হত এগুলো ছাপা
লেখা নয়, এ যেন ওঁর মুখনিঃসৃত বাক্য। পাশাপাশি অন্য
লেখাগুলোও পড়তাম আর পড়তাম ভবানীদার ছড়া। কেন জানি না, প্রথমদিকে
ভবানীদার ছড়া আর সবুজবুড়োর ছড়া পড়ে মনে মনে দুজনকে ছড়াকারদের কুস্তির আখড়ায়
নামিয়েও দিতাম। আর লেখার মুন্সিয়ানায় ভবানীদার গলায় জয়ের মালা পরাতাম। আবারও বলি,
তখন জানতামই না দুজন একই ব্যক্তি। ভবানীদার ছড়া পড়ে তাঁর চরম ভক্ত
হয়ে উঠেছিলাম।
ভক্তদের মনে কখন যে কী
উন্মাদনা জেগে ওঠে তাঁদের প্রিয়জনদেরকে নিয়ে, তা কেউ
ভাবতে পারে না। আমিও ভবানীদার ছড়া পড়তে পড়তে তাঁর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা-ভালোবাসায়
তাঁর ভক্ত হয়ে উঠলাম এবং সবুজবুড়োর লেখা ভালো লাগলেও তাঁর চাইতে ভবানীদার ছড়া আমার
বেশি ভালো লাগে। তা নিয়ে একটি ছড়াও লিখে ফেললাম মনের তাগিদে। তারপর খামে ভরে ওই
কাগজের ঠিকানায় পাঠিয়েও দিয়েছিলাম। বেশ কিছুদিন পর একখানা পোস্টকার্ড আমার ঠিকানায়
এল। প্রেরক সবুজবুড়োর পক্ষে ভবানীপ্রসাদ মজুমদার। তাতে লেখা—‘প্রিয়প্রতিম বাবলু, তোমার লেখা একটি সুন্দর ছড়া
আমাদের দপ্তরে গতকাল এসে পৌঁছেছে। অনিবার্য কারণে ছড়াটি আমাদের কাগজে প্রকাশ করা
যাচ্ছে না। ওটি কোনও বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশের পর তোমাকে তার কপি পাঠানোর ব্যবস্থা
করব। ভালো থেকো।’
ব্যস, আমার মনের মাঠে যেন বিচিত্র বর্ণের সুগন্ধি ফুলের চারা রোপণ
করে দিল ওই চিঠি। দুঃখের বিষয়, হঠাৎ ওভারল্যান্ড দৈনিক
কাগজটি বন্ধ হয়ে গেল। সত্যি বলতে, অধুনালুপ্ত দৈনিক
ওভারল্যান্ড পত্রিকায় সোনার কাঠি বিভাগের মাধ্যমে পরিচালক সবুজবুড়ো অর্থাৎ ভবানীদা
বাংলা শিশুসাহিত্য জগতে বহু নতুন ছড়াকার তৈরি করেছেন, যাঁরা
বহু পত্রিকায় চুটিয়ে লিখে যাচ্ছেন এখন।
দৈনিক ওভারল্যান্ড পত্রিকা
বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর দাদাকে পেলাম প্রথমে ‘সুস্বাস্থ্য’
(পাক্ষিক) পত্রিকার ‘সুস্বাস্থ্যের ছড়া’
বিভাগে, পরে ‘আজকের
পল্লীকথা’ (মাসিক) পত্রিকায়। ‘আজকের
পল্লীকথা’ও আজ বন্ধ হয়ে গেছে। তবে সেখানে ছড়া লেখার সঙ্গে
ছড়া গড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছিলেন তিনি ওই সবুজবুড়ো ছদ্মনামেই।
‘সুস্বাস্থ্য’ ও
‘আজকের পল্লীকথা’ আয়োজিত এক পুরস্কার বিতরণীর
অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গিয়ে তার একদিন আগে ওঁর হাওড়ার বাড়ি গেলাম। দুজনেই পরস্পরকে
প্রথম দেখছি। ওঁর প্রশ্নে নিজের নাম জানাতেই বুকে টেনে নিলেন। তারপর সাদরে ভেতরে
নিয়ে গেলেন। ওই মুহূর্তে আমার উপলব্ধিটি কেমন তা বলতেই হয় আজ। ১৯৮৮ সালের ২রা
এপ্রিল কলকাতার অবন মহলে কিংবদন্তি ব্যক্তিত্ব সত্যজিৎ রায় ওঁর গলায় স্বর্ণপদক
(সুকুমার রায় শতবার্ষিকী পুরস্কার) পরানোর মুহূর্তটি যেমন এক মধুর ক্ষণ, তেমনি আমার সঙ্গে প্রথম দেখার মুহূর্তটিও এক মধুর ক্ষণ। বাড়ির ভেতরে নিয়ে
গিয়ে বসালেন। ভেবে অবাক হলাম, সবে গুটিকয়েক ছড়া লিখেছি,
তেমন কোনও কৃতিত্বের ছাপই নেই শিশুকিশোর বিভাগে, তবু সেই নতুন ছেলেটিকে উৎসাহিত করার জন্য নিজের লেখা ছড়ার বই উপহার দিয়ে
জানিয়ে দিলেন তিনি নিরহংকারী এক রাজা।
তারপরে বহুবার দেখা হল।
আমাকে এবং আমার দুই কন্যাসন্তানকে বই উপহার দিলেন। আজ ছড়ার জগতের সেই রাজা
শারীরিকভাবে রুগ্ন। যাঁরা তাঁকে ভালোবাসেন, অতি নিকট
থেকে চেনেন। তাঁদের কেউ মাঝে মাঝে ওঁর কাছে গেলে দেখবেন তিনি আপনাকে দেখে আজও
শিশুর মতো উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছেন, আর মনের দিক দিয়ে সেই
সবুজবুড়োই হয়ে আছেন। ওঁকে বিনম্র শ্রদ্ধা জানিয়ে ঈশ্বরের কাছে ওঁর সুস্থতা ও
আনন্দময় জীবনের কামনা করি।
<
|