বহুবছর ধরে বিড়াল সমাজের গায়ে ‘চোরা বিড়াল’ বদনামটা সেঁটে আছে। কারণ, ওরা এতো লোভি- দুধ, মাছ বা এই ধরণের খাবার গুলো থেকে কখনো মুখ ঘুরিয়ে নিতে পারে না। এই লোভ ওদের প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে চলে আসছে। তাই এটাকে চুরি করা বা অপরাধ প্রবণ কাজ বলে মনে করে না।
এই তো সেদিনের কথা। এক দুপুরে মিনুর মা মাছ ভেজে উনানে একটা পাত্র ঢাকা দিয়ে ঘরে শু’তে গেছে। কোথায় ছিলো বিড়াল, মাছভাজার গন্ধ ওর নাকে ঢোকে। সুযোগের সৎ ব্যবহার করতে চলে যায় রান্নাঘরের পিছনে। তারপর এক লাফে খোলা জানালা দিয়ে ঢুকে পড়ে। সামনে মাছের কড়াই। থাবা মেরে ঢাকনা খুলে একটা তেল চপচপে মাছের মাথা নিয়ে একলাফে আবার জানালায়। তারপর ঝুপ করে লাফিয়ে পড়ে পিছনের বাগানে। মানকচু গাছের আড়ালে বসে ক্যাঁচর-কোঁচর করে চিবাতে থাকে।
হঠাৎ পিছন থেকে আওয়াজ আসে- ‘এই জন্যে মানুষেরা তোকে বলে চোরা বিড়াল।’
আচমকা কথার শব্দে বিড়াল চমকে উঠে বলে- ‘কে রে?’ ঘুরে দেখে- একটা ধাড়ি ছাগল, গলায় দড়ি দিয়ে বাগানে খোঁটার সঙ্গে বাঁধা।
ছাগল বলে- ‘যেই দেখলি দুপুরে সবাই ঘুমাচ্ছে, অমনি তোর নোলা চুলকে উঠলো।’ বিরক্ত হয়ে আবার বলে- ‘তোদের স্বভাবটা কোনোদিন পাল্টাবে না!’
বিড়াল তিড়িং করে রেগে ওঠে। বলে- ‘চুপ কর তো! বেশি ফ্যাচ-ফ্যাচ না করে নিজের চরকায় তেল দে। একটু আরাম করে খাবো, তা আর তুই খেতে দিবি না!’
ছাগল বলে- ‘খা না! কে তোকে মানা করেছে? তবে মালকিন যা দিচ্ছে- সে তো কম নয়। তবু তোদের-
ছাগলকে থামিয়ে দিয়ে বিড়াল বলে- ‘এই, বেশি জ্ঞান না দিয়ে একটু বোঝার চেষ্টা কর- জঙ্গলের রাজা তো বাঘ।’
ছাগল বলে- ‘হ্যাঁ। তাতে কী হয়েছে?’
বিড়াল বলে- ‘আমরা হলাম সেই বাঘের মাসি। সারাদিনের খাদ্য তালিকায় একটু মাছ-মাংস না থাকলে আমাদের খাওয়াটা জমে না। বুঝেছিস?’
ছাগল বলে- ‘বুঝলাম। তবে আমরা সবাই তো গৃহপালিত জীব। মানুষের আশ্রয়ে থাকি। আর তোরা সেই আশ্রয়দাতার ঘরে চুরি-বাটপাড়ি করবি?’
মাছের মাথাটা পায়ের কাছে রেখে সোজা উঠে দাঁড়িয়ে কোমরে হাত দিয়ে বিড়াল বলে- ‘আমরা গৃহপালিত, তা বলে তোদের সঙ্গে আমাদের এক ভাববি না। বাগানের ঘাস-পাতা খেয়ে পরাধীন ভাবে বেঁচে থাকা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। আমরা মানুষের আশ্রয়ে থাকলেও তবু স্বাধীন জীবনযাত্রা পছন্দ করি।’
ঠাণ্ডা মাথায় ছাগল বলে- ‘ঠিক আছে। যার যেমন সুবিধা, সে তেমন ভাবে জীবন যাপন করুক না! অসুবিধা কোথায়! তা বলে চুরি!’
বিড়াল বিরক্ত হয়ে বলে- ‘নারে খেলে যা! তোদের স্বভাবটা ঠিক মানুষের মতো। বার বার একই কথা- চুরি আর চুরি! এছাড়া অন্য কথা মুখে নেই? চুরি করে খাওয়া যদি দোষের হতো, তাহলে আমাদের পূর্বপুরুষেরা একাজ করতে বারণ করে যেতো।’
ছাগলও তিতি-বিরক্ত হয়ে বলে- ‘তোরা হলি দু’কান কাটা জাত! যে কোনো পশু সমাজের বদনাম আমাদের গায়ে বড্ড লাগে। কিন্তু তোদের তা লাগে না।’
হঠাৎ মিনুর মা রান্নাঘর থেকে চিল-চিৎকার করে ওঠে- ‘যা-যা, যাঃ! ভাজা মাছ গুলো সব চোরা বিড়ালে নিয়ে গেলো গো! যাঃ! মিনু। দেখে যা- তোর আদরের হতচ্ছাড়ি বিড়ালের কাণ্ড! এবার ওকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করবো!’
চিৎকার শুনে বিড়াল আধ-খাওয়া মাছের মাথা আবার কামড়ে নিয়ে একলাফে ওঠে বাগানের পাঁচিলে। তারপর পাঁচিল থেকে ওপারে রাস্তায় পড়ে একদৌড়ে ঢুকে যায় সোজা ঝোপ-জঙ্গলের ভিতরে। বিড়ালের কাণ্ড দেখে ছাগল হেসে লুটোপুটি খেয়ে মনে মনে বলে- দেখেছো চোরা বিড়ালের কাণ্ড! এরাই হলো রাজার মাসি।
কয়েকদিন পর একদুপুরে মিনুরা খেতে বসে। খাওয়ার শেষে মিনু মাকে বলে যায়- ‘মা। বিড়ালকে দুটো খেতে দিও।’ তারপর হাত মুখ ধুয়ে নিজের ঘরে চলে যায়।
বিড়াল দূরে বসে জিভ দিয়ে টুক-টুক করে লেজ নেড়ে মেঁও মেঁও করে। ভাবে- মানুষেরা ভীষণ স্বার্থপর! ভাল ভাল খাবারের একচেটিয়া অধিকার শুধু ওদের! আমরাও তো পৃথিবীর জীব। তবু আমাদের কোনো হক নেই! বাধ্য হয়ে চুরি করতে হয়। আর তখনই ইনিয়ে বিনিয়ে কত রকম করে চোর বদনাম দেয়। তোরা তো বই-পত্র পড়িস! তবু জানিস না- চুরি করে খাওয়া আমাদের বংশের ধারা! তবু অপবাদ কেন দিস!
একটু পরে মিনুর মা সবার পাতের মাছের কাঁটা গুলো তুলে ওর সঙ্গে কিছু উচ্ছিষ্ট ভাত মেখে একটু দূরে মাটিতে বিড়ালকে খেতে দেয়। কিছুক্ষণ পরে দেখে, যেমন খাবার তেমন পড়ে আছে। মেয়েকে ডেকে বলে-
‘মিনু। তোর বিড়ালের রগড় দেখে যা।’ বিড়ালটা মিনুর খুব আদরের। তাই নিজের নামের সঙ্গে মিলিয়ে ওর নাম দিয়েছে- মিনি। ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বলে-
‘কী রে মিনি, সব পড়ে রইলো! খাচ্ছিস না কেন?’
বিড়াল অভিমান করে বলে- ‘না। আমি আর আঁশ খাবো না।’
মিনুর মা ব্যঙ্গ করে বলে-
‘আহা-হা! ও নাকি আঁশ খাবে না! বিড়ালজাত আঁশ খাবি না তো কি বৈরাগি হবি?’
ভারাক্রান্ত মনে বিড়াল বলে-
‘হ্যাঁ, তাই হবো। সারাজীবন আমরা তোমাদের কাছে বদনাম শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা হয়ে গেলো।’
বিড়ালের কথায় মিনু অবাক। বলে-
‘সেকি রে মিনি! তুই একি কথা বলছিস?’
বিড়াল বলে-
আমি ঠিকই বলছি। সবাই চোর বলে। এ অপবাদ আর সহ্য করতে পারছি না। এবার চলে যাবো।’
মিনু আরো অবাক হয়- ‘চলে যাবি- মানে? কোথায় যাবি?’
বিড়াল বলে- ‘বৃন্দাবনে।’
এবার মিনু হাল্কা তিরস্কার করে বলে- ‘মাথা গরম করিস না। চল, ঘরে চল।’ বিড়ালকে কোলে নিয়ে আদর করতে করতে ঘরে চলে যায় ।
মিনুর কথায় বিড়ালের মন ভিজলো না। স্থির সিদ্ধান্ত নিয়েই নিয়েছে- ও বৈরাগি হবেই। হপ্তা খানেক পার না হতেই কাউকে না বলে হাতে লাঠি, কপালে তিলক, গায়ে গেরুয়া পোশাক চাপিয়ে খুব ভোর ভোর বেরিয়ে পড়ে। আপাতত বড় রাস্তায় উঠে কোনো এক ধাবার কাছে ঘাপটি মেরে থাকবে। ধাবায় তো অনেক লরির চালকরা চা জল খাবার খায়, গল্প গুজব করে। তখন শুনে নেবে- কোন ড্রাইভারের গাড়ি উত্তর প্রদেশ, দিল্লী যাচ্ছে। তারপর ঝপাঝপ সেই গাড়িতে উঠে পড়বে।
সময়টা বর্ষাকাল। তাড়াতাড়ি রাস্তায় ওঠার জন্য মোড়লদের বাঁশঝাড় পার হয়ে, সাধন দাসের কলাবাগানের ভিতর দিয়ে চলে আসে হালদারদের পশ্চিমের পুকুর পাড়ে। ওখান থেকে মাটির রাস্তা ধরে যেতে হঠাৎ পুকুর থেকে লাফিয়ে ওঠে একটা চ্যাংমাছ। গাড়ির ব্রেকে চাপ দিলে যেমন, ঠিক ঐ রকম ভাবে দাঁড়িয়ে পড়ে বিড়াল। ভাবে- সবই বাবা রাধামাধবের লীলা। আমার মনে সত্যিকারে বৈরাগ্যভাব এসেছে কিনা- তা পরীক্ষা করতে বাবা হয়তো এই চ্যাংমাছকে পাঠিয়েছে।
বৃষ্টি হলে পুকুর থেকে মাছ লাফ দিয়ে ডাঙায় ওঠে। ঐ মাছ ধরতে পাশে ঝোপের মধ্যে বসেছিলো একটা কোলা ব্যাং। ও মাছকে দেখতে পেয়ে খাবে বলে থপ-থপ করে এগিয়ে আসে। তাই দেখে বিড়ালের মাথাটা গরম হয়ে ওঠে। লাঠি উঁচিয়ে বলে-
‘দেখেছিস এই লাঠি? মেরে ঠাণ্ডা করে দেবো’ ভয়ে থমকে ব্যাং দু’পা পিছিয়ে যায়। বিড়াল উপদেশ দিতে থাকে-
‘জানিস না- জীব হত্যা মহাপাপ? মহাপ্রভূ নিমাই, তথাগত বুদ্ধদেবের দেশে জন্মেছিস তবু মনে এতো হিংসা কেন? একটু ধর্মকর্মে মন দে। মরে যমালয়ে গিয়ে কী জবাব দিবি, য়্যাঁ?’
ব্যাং একটু সাহস করে বলে-
‘ও মাসি। তুমি একি কথা বলছো গো? স্বামীজি তো বলেছে- খালি পেটে ধর্ম হয় না।’
বাজখাই স্বরে বিড়াল বলে-
‘চোপ! আমিও তো গেরুয়া পরেছি। আর তুই আমাকে স্বামীজি শেখাচ্ছিস? এমন একটা মার দেবো না- পটল তুলতে পথ পাবি না।’
ব্যাং থতমত খেয়ে আরো কয়েক পা পিছিয়ে যায়। আবার একটু সাহস সঞ্চয় করে নিয়ে বলে-
‘মাসি, তুমি বলছো- জীব হত্যা মহাপাপ। আমি তো একটা জীব। তাহলে আমাকে মারবে বলছো কী করে?’
নিজের কথার প্যাঁচে বিড়াল নিজেই জড়িয়ে যায়। এরপর রাগটা যেন প্রচণ্ড বেড়ে যায়। বলে-
‘কী! সামান্য চুটকি ব্যাং! তোর এত্তো সাহস! দেখবি, মজা দেখাবো?’ বলে ব্যাংএর দিকে ধেয়ে যায় ।
থপথপে ব্যাং দৌড় দিয়ে বিড়ালের কাছে পেরে উঠবে না। তাই তাড়াতাড়ি বলে-
‘ক্ষমা করো মাসি।’ তারপর ঝপাং করে লাফ দিয়ে পুকুরে পড়ে।
রণে ভঙ্গ দিয়েও বিড়ালের সৎ চিন্তার মধ্যে সর্বনাশা বেনোজল ঢুকতে থাকে। হতে থাকে নোলার টানা-পোড়ন। ভাবে- একটা গোটা হপ্তা শুখা গেছে। পেটে কোনো আঁশের গন্ধ ঢোকে নি। সেখানে মুখের কাছে এমন দাঁও...। ভাবতে পারছে না- কী করবে! বহুদিনের অভ্যাস, এতো সহজে ছাড়া যায়! আবার বৃন্দাবনের চৌহদ্দিতে ঢুকে পড়লে আমিষ খাওয়া ভুলে যেতে হবে চিরদিনের মতো। তাছাড়া এর আগে কতো সাধু মহারাজদের এরকম কাণ্ড-কারখানা বহু শুনেছে। উপর উপর হরি হরি, পিছনে বা কাকে ডরি! অতএব শেষবারের মতো একটা দিন না হয় মৎসের স্বাদ সৎ ব্যবহার করলাম! এতে এমন কিছু মহাভারত অশুদ্ধ হবে না। আবার ভাবে- বাবা রাধামাধবের শরণাপন্ন হয়ে পাপ কাজে লিপ্ত হবো! যা হয় হোক। অতো ভাবতে গেলে সাধ পূরণ হবে না। এদিক ওদিক ভাল করে দেখে। কেউ কোথাও নেই। এই ফাঁকে জিভ দিয়ে ঠোঁটটা বুলিয়ে নিয়ে, গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে যায় চ্যাংমাছের দিকে। তারপর খপ করে এক কামড়ে চ্যাংমাছটা ধরে তোলে।
ওদিকে পুকুরের জলে কোলাব্যাং ভাসতে ভাসতে বিড়ালকে নিরীক্ষণ করতে থাকে। ভাবে- বিড়াল চলে গেলে আবার ডাঙায় উঠে মাছটাকে ধরে খাবে। বিড়ালের কাণ্ড-কারখানা দেখে অবাক হয়ে বলে-
‘ও মাসি। আমাকে সৎ উপদেশ দিয়ে তুমি ওটা কী করলে?’
ব্যাংয়ের কাছে ধরা পড়ে বিড়াল ভীষণ লজ্জায় পায়। তাড়াতাড়ি চ্যাংমাছটা গিলে নিয়ে, পুকুরের জলে ভাল করে কুলকুচো করে আবার বৃন্দাবনে যাওয়ার উদ্দেশ্যে সোজা হাঁটা দেয় গ্রাণ্ড ট্যাঙ্ক রোডের দিকে।