অন্তরের আসন খানি
তাঁকে আজ দিলাম আনি
হাজার ছন্দ মজুদ যাঁর
ভবানীপ্রসাদ মজুমদার।
ভবানীদার সঙ্গে আমার
শারীরিক পরিচয় বিশ-বাইশ বছর আগে অম্বিকা কালনায়, সমর কুমার চট্যোপাধ্যায়ের পরত পত্রিকার অনুষ্ঠানে। সেটা তো
সাক্ষাৎ-পরিচয়। তারও অনেক আগে সেই আটের দশকের শুরুতে ভবানীদার পাণ্ডুলিপির সঙ্গে
আমার পরিচয়। তখন আমি উচ্চমাধ্যমিক ছাত্র কোচবিহার সমাচারের ‘শিশুমিতা’
বিভাগে ছড়া লিখি। ভবানীদা কোচবিহার সমাচারের ‘শিশুমিতা’ বিভাগে নিয়মিত ছড়া পাঠাতেন। আমি যেহেতু
কোচবিহার শহরেরই ছেলে, কাজেই কোচবিহার সমাচারের ভিতরে প্রবেশ
করার অধিকার ছিল অবাধ। শিশুমিতা বিভাগটি মূলত পরিচালনা করতেন সারথিছন্দক ছদ্মনামে
কোচবিহারের বিখ্যাত নাট্যকার নিরোজ বিশ্বাস ও ইতিহাসবিদ ড. নৃপেন্দ্রনাথ পাল। আমি
দুজনেরই অত্যন্ত স্নেহভাজন ছিলাম। তখন দূরের লেখা আসত ডাকে। আমি কাগজে ছড়া লিখে
সটান চলে যেতাম পত্রিকা দপ্তরে। সেখানেই নৃপেনদা একদিন ভবানীদার লেখা পাণ্ডুলিপি
আমাকে দেখালেন। ভারি অদ্ভুত সেই পাণ্ডুলিপি। ছড়ার স্তবকগুলো বিভিন্ন রঙের স্কেচ
পেন দিয়ে লেখা, বহুবর্ণে রঞ্জিত ছড়ার পাতা। আমি মুগ্ধ হয়ে
ছড়াগুলো পড়তাম। অপূর্ব লাগত ছন্দ গড়ার মুন্সিয়ানা আর শব্দচয়ন। পত্রিকাটি ছিল
সাপ্তাহিক। আমি সপ্তাহে অন্তত একবার পত্রিকা দপ্তরে ঢুঁ মেরে যেতাম শুধু লেখা জমা
দেওয়ার জন্য নয়, ডাকে যেসব ছড়া-গল্প আসত সেগুলো পড়বার জন্য।
ভবানীদার লেখা পড়বার মজাটাই ছিল অন্যরকম।
সেই আটের দশকের মাঝামাঝি
সময়ে কোচবিহার জেলার আরেক প্রান্ত চ্যাংড়াবান্ধা থেকে আর একটি শিশুকিশোর পত্রিকা
প্রকাশিত হত, যার নাম ছিল ‘টিনটিন’। সেখানেও ভবানীদা ছড়া পাঠাতেন। আমিও দু-একবার
লিখেছিলাম। টিনটিনের দৌলতে ভবানীদার লেখা বেশ কয়েকটি ছড়া পাঠ করবার সৌভাগ্য আমার
হয়।
আটের দশকের দ্বিতীয়ার্ধ।
আমি তখন উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। প্রখর দারিদ্র্য, বাবার সাধারণ চাকরি, তার উপর তিনি এতটাই
অসুস্থ থাকতেন যে প্রতিমাসেই বেতন কাটা যেত। কী করে দু-চারটে পয়সা উপার্জন করা
যায়, সেই চিন্তা করতে করতে একদিন ছড়া নিয়ে উত্তরবঙ্গ সংবাদ
অফিসে হাজির হলাম। তখন উত্তরবঙ্গ সংবাদপত্রে শনিবারে ‘শিশুকিশোর
আসর’ বলে একটি পাতা ছিল। আমি বিশ্বস্ত সূত্রে জানতে
পেরেছিলাম, একটি ছড়া ছাপলে কুড়ি টাকা পাওয়া যায়। আমি তখন
পঞ্চান্ন টাকা বাড়িভাড়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের এক কিলোমিটার দূরে এক টিনের ঘরের
বারান্দায় ছোট্ট এক-কামরার ঘরে থাকি। কাজেই ভাবলাম, যদি
মাসে দুইটি ছড়াও প্রকাশিত হয় তাহলে চল্লিশ টাকা পাব। ভাড়ার টাকা প্রায় ওঠে আসবে।
আর তিনটে ছড়া প্রকাশিত হলে তো কথাই নেই।
পাঠক এতক্ষণ নিশ্চয় ভাবছেন
এর সঙ্গে ভবানীপ্রসাদ মজুমদারের কী সম্পর্ক! আছে। অবশ্যই আছে। না-হলে ধান ভানতে
শিবের গীত গাইতাম না।
আমি তো ছড়া নিয়ে ‘শিশুকিশোর আসর’ দপ্তরের বিভাগীয়
সম্পাদকের টেবিলে গেলাম। আমি আমার ছড়া দিলাম, মনোনীত হবে কি
না হবে সে সপ্তাহ পর জানা যাবে। সম্পাদকীয় দপ্তরে তখন আলোচনা চলছিল শিশুকিশোর আসরে
যেসব ছড়া গল্প এসেছে সেসব গল্প-ছড়ার চিত্ররূপ অর্থাৎ ইলাস্ট্রেশন করবার
চিত্রশিল্পী আপাতত নেই। আমি সাহস করে বললাম, ‘আমি টুকটাক ছবি
আঁকতে পারি। আপনারা যদি সুযোগ দেন আমি সাধ্যমতো চেষ্টা করব।’
সম্পাদকমণ্ডলী কী বুঝলেন
জানি না, আমার হাতে একগুচ্ছ ছড়া গল্প গুঁজে দিয়ে বললেন, ‘প্রত্যেক সপ্তাহে দুটি করে ইলাস্ট্রেশন করে নিয়ে আসবে, আমরা সেভাবেই গল্প-ছড়াগুলো প্রকাশ করব।’
সেখানে ভবানীদার লেখাও
একটি ছড়া ছিল। সেই ছন্দ, সেই বিচিত্রময় রঙবেরঙের স্কেচ পেনে
লেখা। মনে মনে ভাবলাম—
ভবানীদার পাণ্ডুলিপি
শিথানে সারারাত
যেমন তাঁর হাতের লেখা
তেমনি লেখার হাত।
তারপর কত বর্ষা, কত হেমন্ত বসন্ত পেরিয়ে যায়।
জীবন সংগ্রামে আমি বেকার।
আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীল সরকারি মহাবিদ্যালয়ের আংশিক সময়ের অধ্যাপনা। ভবানীদার
সঙ্গে আমার সম্পর্ক অটুট। তাঁর কত কবিতা পড়া। সারা বাংলার ক্ষুদ্র পত্রপত্রিকায়
একসঙ্গে অজস্র লেখা প্রকাশিত। শুধু কি তাঁর সঙ্গে লেখা, তাঁর ছড়া গ্রন্থ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়া!
তাঁর লেখা আমি পড়িয়েছি
উচ্চমাধ্যমিক স্কুলে। আমি ততদিনে আংশিক সময়ের অধ্যাপনা ছেড়ে পূর্ণ সময়ের স্থায়ী
উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষক। আমি উচ্চমাধ্যমিকের দর্শন শিক্ষক হলেও আমাকে মাধ্যমিক স্তর
পর্যন্ত বাংলা, ইংরেজি ও সংস্কৃত পড়াতে হত।
বাচ্চাদের পড়াতে আমার চিরকালই ভালো লাগে। আমি কয়েকটা ক্লাসের সঙ্গে পঞ্চম
শ্রেণিতেও বাংলা পড়তাম। বর্তমান সরকার আসার পর দেখি ভবানীদার লেখা ‘দারোগাবাবু ও হাবু’ পঞ্চম শ্রেণির পাঠ্য। এই কবিতাটি
যখন ক্লাসে আবৃত্তি করে পড়াতাম, বাচ্চারা আনন্দ-বিস্ময়ে তা
অবধান করত। এ আমার পরম সৌভাগ্য। আমি ছাত্রদের বলতাম, ভবানীদা
আমার অত্যন্ত কাছের মানুষ আমার, একান্ত পরিচিত। ছাত্ররা
বিশ্বাস করত কি না আমি জানি না। কারণ, কোচবিহারের প্রত্যন্ত
গ্রামের ছাত্র শুধু নয়, অভিভাবকদেরও বোঝানো কঠিন একজন পাঠ্য
বইয়ের লেখক আমার পরিচিত হতে পারেন।
২০১৫-তে নির্মলেন্দু
শাখারুর সম্পাদনায় ‘ভবানী চর্চা’ বইটি
প্রকাশিত হয়। প্রকাশক মাধবচন্দ্র সিংহ, সুভাষ পল্লী, মালদা। সেখানে ‘স্বয়ংসিদ্ধ ছড়াকার’ নামক ছড়ায় আমি ভবানীদাকে যেভাবে দেখেছি, সেভাবেই
স্মরণ করেছি।
স্বয়ংসিদ্ধ ছড়াকার
চমকে উঠে পাঠক তাঁর
এমন মধুর ছড়া কার!
কে সব ছন্দ রূপকার?
এ কি কথা! তাও জানো না
ভবানীপ্রসাদ মজুমদার।
ছন্দে তাঁর ঝরনা ছোটে
ফুল ফোটে যে গাছে
ছন্দে তাঁর পাখপাখালি
গাছে গাছে নাচে।
দুঃখ সুখের কত কথাই
ছন্দে গাঁথে মালা
ছন্দ তাঁর উদাস করে
জুড়ায় বুকের জ্বালা।’
ভবানীদার সঙ্গে আমার শেষ
সাক্ষাৎ আমার শহর কোচবিহারে। কোচবিহারের ছন্দ-যতি আবৃত্তি সংস্থার উদ্যোগে একটি
আন্তর্জাতিক অনুষ্ঠান করা হয়েছিল। আন্তর্জাতিক বলতে বাংলাদেশের একজন বাচিক শিল্পী
সেই অনুষ্ঠানে হাজির ছিলেন। ভবানীদা ছিলেন সেই অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি। ভবানীদা
উঠেছিলেন কোচবিহারের আর এক ছড়াকার আমার দাদাস্থানীয় শুভাশিস চৌধুরীর বাড়িতে।
আমার মাধ্যমেই এই আবৃত্তি সংস্থা ভবানীদার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল। কাজেই এই
অনুষ্ঠানে কর্মকর্তাদের আমিও একজন ছিলাম। সেই সময় ভবানীদাকে একান্ত কাছে থেকে
দেখবার সুযোগ হয়েছিল। যে ক’টি দিন তিনি কোচবিহারে ছিলেন, দেখতাম অবসর পেলেই তিনি বসে পড়ছেন খাতা নিয়ে ছড়া লিখতে। বিশ্ব সংসারের
আনন্দ-বেদনা, কান্না-হাসি, শোক-তাপ,
ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ সব যেন ফুটে উঠছে তাঁর ছন্দে।
কয়েক বছর ধরে ভবানীদা
সঙ্গে আমার যোগাযোগ নেই। আমি উত্তরের মানুষ, দক্ষিণবঙ্গের
অনুষ্ঠানগুলোতে এখন আর প্রায় যাওয়া হয় না। দূরালাপে চেষ্টা করেছি; আমার কাছে যে মোবাইল নম্বর আছে কল করলে ‘সুইচড অফ,
সুইচড অফ’ বলে। কথা আর হয় না। শুনেছি ভবানীদা
শারীরিকভাবে ভালো নেই। ভক্তদের ভক্তির আধিক্য বিড়ম্বনার কারণ হয় আজকাল। ভবানীদা
অথবা বউদি হয়তো-বা সেজন্যই মোবাইল বন্ধ করে রাখেন।
ভালো থাকুন প্রিয় দাদা
ছন্দে ও ছড়াতে। প্রণাম।