স্কুলের ছুটিতে
শহর ছেড়ে পিশির সাথে গ্ৰামে, রতনপুর পিশির বাড়ি চলছে শ্রেয়া। মে মাসের তীব্র গরম, বিস্তৃর্ন মাঠের বুক চিরে ছুটে চলেছে ট্রেন। জানলার ধারে
বসে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকে।
সবকিছু পিছনে ফেলে ট্রেনটা চলছে, আবার থামছে। শ্রেয়া তন্ময় হয়ে তাকিয়ে থাকে,
ঘোর কাটলো পিশির কথায়, আমরা পরের
স্টেশনে নামবো। নাও বোতলের জলটুক
শেষ করে দাও। পিশির কথা মতো জল খেয়ে পিশির হাতটা শক্ত করে ধরে। ট্রেনটা ধীরে ধীরে
চলতে চলতে এক সময় দাঁড়িয়ে যায়। ফাঁকা
স্টেশন, অল্প কয়েকজন যাত্রী নেমেছে।
পিশির হাত ধরে যেতে যেতে দেখললো লেখা রয়েছে রতনপুর। পাশেই রিক্স ভ্যানের স্ট্যান্ড, তারই একটা তে
শ্রেয়াকে বসিয়ে, পিশি উঠে বসে। ভ্যান রিক্সর উদ্দেশ্যে বলে, চলো তাড়াতাড়ি
যা গরম পড়েছে।
গরম হাওয়ায় লালমাটির ওড়া ধুলোয় প্যাডেলের ক্যাঁচর ক্যাঁচ শব্দে চলতে থাকে সেই গাড়ি। মাঝে মাঝে
গাছগাছালির ছায়া, খোটায় বাঁধা গরুর হাম্বা ডাক, অচেনা পাখির
ডাক সবকিছুই অবাক হয়ে দেখে আর শোনে
সে। শহরে কি আর এসব দেখা যায়! একসময়
তেমাথানি এক মোড়ে আসতেই পিশি চিৎকার করে বলে ওঠে এখানে এখানে, এখনে দাড়াও।
আয় শ্রেয়া নাম, পিশি ব্যাগ দুটো হাতে নিয়ে নামে। ততক্ষণে
শ্রেয়া এক লাফে নেমে দৌড় লাগায়। কতদিন পর পিশির বাড়ি এসেছে। মজা খালের বাঁশের সাঁকোটা
পেরিয়ে বনতুলসির বেড়ায় ঘেরা, বাঁশের বেড়ার দরজা খুলে ভেতরে ঢোকে সে। আজ তার জন্যই অপেক্ষা করছে, দাদা অর্ঘ দিদি
শ্রাবণী।
শ্রেয়াকে পেয়ে তারা আনন্দে আত্মহারা। এ ঘর ও ঘর কত ছবি এঁকেছে অর্ঘ। আর শ্রাবণীর পুতুল ঘর। অর্ঘ বলে কাল তোমাকে বটতলার মাঠে নিয়ে যাব,
সারাদিন খেলবো, ঢিল মেরে আম পাড়বো। সঙ্গে সঙ্গে শ্রাবণী বলে ওঠে না
শ্রেয়া, আগে তোকে কুসুম ডাঙার শালুক দিঘির পাড়ে নিয়ে যাবো কত রকমের পাখি সেখানে,
আর দিঘিতে ফোটে লাল শালুক।
হঠাৎই পিশির গলা, এই অর্ঘ শ্রাবণী তোরা একটু চুপ কর। ওকে একটু বসতে দাঁড়াতে দে। তখন থেকে বকবক করছিস। বেচারা এতোটা রাস্তা গাড়িতে গাড়িতে এলো। নে
শ্রেয়া, মা জামা প্যান্ট ছেড়ে হাত মুখ ধুয়ে নে,
আমি ঘুগনি পরোটা দিয়ে যাচ্ছি। নে সবাই আয় খেয়ে নে। হৈ হৈ করে খেতে আসে ওরা। খেতে খেতে শ্রেয়া বারান্দা থেকে দেখে, দুরে সূর্যটা
কেমন ঝোপ জঙ্গলের মধ্যে লুকিয়ে পড়ছে। খালের জলে তার লাল রং। সন্ধ্যে নেমে গেছে কখন, চারদিকে
ঘুটঘুটে অন্ধকারের ভেতর ডেকে যাচ্ছে ঝিঁ ঝিঁ। বাড়ির পিছনে বাঁশের বনে হাওয়ায় ওঠে শব্দ।
হঠাৎ কিসের যেন ডাকে ভয় পেয়ে যায় শ্রেয়া।আর তাতেই হো হো করে হেসে ওঠে অর্ঘ শ্রাবণী।
ভয় কি ওটা শেয়ালের ডাক। সন্ধ্যে হলেই
ডাকে, ঐ মাঠের দিক থেকে
ডাকছে। ঐ, ঐ শোন আবার
ডাকছে, হুক্কা হুয়া।
শ্রাবণী বলে আরো কত কিছু ডাকে রাতের বেলা, ভাম, পেঁচা, বনবিড়াল খটাশ।
তোমাদের ভয় করে না!
ভয় করবে কেন? আমরা তো এসব রোজ শুনি।
অর্ঘ বলে, তুমি শেয়াল দেখেছো?
শ্রেয়া মাথা ঝাঁকিয়ে বলে হাঁ, চিড়িয়াখানায় দেখেছি।
এরপরই অর্ঘ শ্রাবণীর ঠাকুমা এসে জিজ্ঞেস করে, কি দাদা দিদিরা,
তোমাদের কি গল্প হচ্ছে?
ঠাকুমাকে দেখে উল্লোসিত সবাই। অর্ঘ বলে ওঠে ঠাকুমা,
আজ একটা বড় গল্প বলবে।
তা, তোমরা কোন গল্প শুনবে আজ। রাক্ষস খক্ষস না কি ব্যঙ্গমা
ব্যঙ্গমির।
অর্ঘ বলে ভুতের একটা গল্প বলো।
শ্রাবণী বলে ওঠে না ঠাকুমা ভুতের নয়। কাল যেখানে শেষ করেছিলে, পাতালপুরী থেকে
রাজপুত্র
কিভাবে
রাক্ষসীর হাত থেকে রাজকন্যাকে মুক্ত করলো সেটাই বলো।
ঠিক আছে দিদিভাই, ঐ টাই আজ শেষ করি।
ঠাকুমা তিন জনকে কাছে টেনে, শুরু করে গল্প।
ঠাকুমার সে গল্প শুনতে শুনতে শ্রেয়া হারিয়ে যায় এক কল্পনার জগতে।
রাজকুমারের বিরত্বে ভরে ওঠে মনটা। আর রাজকন্যা, রাক্ষশ খক্ষশ, রাজপুত্র কেমন যেন জীবন্ত হয়ে ওঠে। মনে হয় পক্ষীরাজের
ঘোড়ায় চড়ে রাজপুত্র রাজকন্যাকে নিয়ে এই বুঝি নামলো তাদের বাড়ির সামনে।
এভাবেই শ্রেয়ার বেশ কিছু দিন গেল পিসির বাড়ি।এই কদিনে অর্ঘ শ্রাবণীর সঙ্গে ঘুরে চেনা
হয়ে গেছে শালুক
দিঘির পাড়, কুসুমডাঙার মাঠ, বসন্তপুরের পোড়ো ডাঙা। বন্ধু ও হয়েছে অনেক।
গরমের ছুটি শেষ হতে আর তিনদিন বাকি। তারপরই স্কল, পড়া পরীক্ষা।
বাবা কাল শ্রেয়াকে নিতে আসবে। আজ
বড়ো মন খারাপ তাই। পিসির বাড়ি থেকে যেতে ইচ্ছে করছে না কিছুতেই। শ্রাবণীর সেই পুতুল
খেলার ঘরে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে সে। কাল থেকে আর ঠাকুমার গল্প শুনতে পাবে না,
পাবে না ঠাকুমার আদর। শহরে তো কেউ এভাবে গল্প বলে না। অথচ তার নিজের ও একটা
ঠাকুমা ছিল।
সারাদিন ভরিয়ে রাখতো আদর ভালোবাসায়, বলতো গল্প ও। সেদিন
গাড়িতে চাপিয়ে বাবা ঠাকুমাকে কোথায় যে নিয়ে গেল, বাবা এলো
ঠাকুমা আর এলো না। ঠাকুমা কোথায় মা? আসছে না কেন?
মা বলেছিল, ঠাকুমা কুটুম গেছে, এখন থেকে ওখানেই থাকবে। খুব রাগ হয়েছিল সেদিন,
এতোদিন কেউ কুটুম বাড়ি থাকে। আমি তো পিসির বাড়ি থেকে বাড়ি যাচ্ছি, তাহলে ঠাকুমা
কেন ফিরছে না! আমার জন্য
কি তোমার মন খারাপ হয় না ঠাকুমা! তুমি ফিরে এসো ঠাকুমা ফিরে এসো। শ্রেয়ার এই
কান্নার আর্তি আড়াল থেকে শোনে পিসি। কাছে টেনে আঁচল দিয়ে চোখ মুছিয়ে দেয়।
নিজেও চোখ মোছে। এক সময় বলে কাঁদিস না মা।
বাবা এসে গেছে নিচে আয়।
শ্রেয়া লক্ষ্য করে পিসি একটু তফাতে চাপা স্বরে কি যেন বলছে! কানে আসে,
কাজটা তোমার ঠিক হয়নি দাদা। সংসার থেকে কাউকে সরিয়ে দিলেই ভালো থাকা যায় না।
বয়স্ক বাবা মা ই তো সংসারের খুঁটি। তাদের সম্নানের সঙ্গে বাড়িতে রাখাই রীতি এটাই কর্তব্য।
শ্রেয়া লক্ষ্য করে বাবার মুখ কেমন থমথমে আর গম্ভীর। একসময় বাবা বলে, ঠিক বলেছিস
ভুলটা আমাদের। আজ বুঝতে পারছি, শ্রেয়া কেন এতো মনমরা, ওর হাসি খুশি চঞ্চলতা কোথায় যেন
হারিয়ে গেছে! শ্রেয়াকে জড়িয়ে ধরে বলে, তুই চোখ খুলে দিলি মা, আজ বুঝতে পারছি ছোটদের কাছে
দাদু ঠাকুমার গুরুত্ব কতটা। আর বাড়িতে কিভাবে তোর একাকিত্বে কাটে বুঝতে পারলাম।
আর নয় চল শ্রেয়া, আজই এখনই যাই তোর ঠাকুমার কাছে। বৃদ্ধাশ্রমের সেই ছোট্ট ঘর,
যেখানে তোর ঠাকুমা আজ দেড় বছর আছে। বাবার এই সবার মুখ খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে পিসি, ঠাকুমার।
শ্রেয়ার সঙ্গে অর্ঘ শ্রাবণী ও হৈ রৈ করে উঠলো হঠাৎ। বাবা বলে ওঠে চল মা দেরি হয়ে
যাচ্ছে। একটা খুশির আবহে সবাই বেরিয়ে আসে রাস্তায়,
ওরা উঠে যায় ভ্যান রিক্সায়। ঝিকঝিক শব্দে ট্রেন ছুটছে আগের মতোই। একসময়
শ্রেয়া বলে ওঠে,
বাবা বৃদ্ধাশ্রমটা আর কতদূর!
সামান্যই, এসে গেছি।
বৃদ্ধাশ্রমের সেই ছোট্ট ঘরে ঠাকুমাকে দেখে জড়িয়ে ধরে শ্রেয়া। নাতনিকে পেয়ে
চোখ থেকে টপ টপ জল পড়ে। বাবা বলে
ওঠে, চলো মা, বাড়ি চলো।
হাঁ ঠাকুমা, তুমি এখনি বাড়ি চলো। কতদিন গল্প বলো নি বলো তো, সেই ভুত
রাক্ষসের গল্প, পরীদের গল্প। নাও বাবা, ঠাকুমার ব্যাগগুলো নাও। শ্রেয়া সেই আগের মতোই
ঠাকুমার আঁচলটা চেপে ধরে। ঠাকুমাকে সঙ্গে
নিয়ে বাবার পিছু পিছু হাঁটতে থাকে শ্রেয়া।