অশোক অধিকারী

                                                                                                                                                                                                                    ছবি - রাহুল মজুমদার
     ভবানীপ্রসাদ মজুমদারের   ছড়ার প্রসঙ্গ কথা









অশোক অধিকারী

 

বললে হবে, খরচা আছে! বললে হবে, খরচা আছে!

কথা খরচের যেমন একটা প্রাসঙ্গিকতা থাকেতেমনই বলার একটি ধরনও থাকে। আবার প্রয়োগের একটি দায়ও থাকে। বিশেষত সচল মস্তিষ্কের সুষুম্নায় যখন চোরাগোপ্তা রক্ত চলাচল অব্যাহত থাকেআবার চিন্তার সহজাত আবেগ বিদ্যমান থাকেতখন সহজ কথা সহজ করে বলার প্ল্যাটফর্ম সৃষ্টিকারকে বেছে নিতে হয়। যদিও প্রেক্ষিত যখন যাবতীয় কথা বলার পক্ষে সুলভ থাকে নাঅথচ অনুভূতি ব্যক্ত করা প্রয়োজন তখন সৎ প্রায়োগিক হিসাবে একজন মনস্ক অনুভাবকের সামনে সমাজচেতনার নিরিখ ব্ল্যাকবোর্ড হয়ে সামনে মেলে ধরে নিজেকে। ক্যানভাসের বাহুল্য বর্জন করেও যিনি মনের কথা কখনও শ্লেষব্যাজস্তুতিঅনুপ্রাস অথবা সময়কে ধরার জন্য যে-ধরনের প্রকাশ কৌশল ব্যবহার করা যায় তাই দিয়ে পাঠকের কানে পৌঁছে দেন উত্তমর্ণ অগ্রজ চিন্তাতিনি আর যাই হন না কেন কুহকের মায়াজাল বিস্তারের ধাঁধা থেকে শত হাত দূরে তাঁর বসতি রচনা করেন

এতগুলো কথা বলার কারণ হিসাবে শুরুতে ভবানীপ্রসাদের একটি জনপ্রিয় (!) ছড়ার লাইনটি যথেষ্ট বলে মনে করার কারণ আছে। শুধু কথা বলার জন্যে কথা বলা নয়কেন বলব বা কীভাবে বলব ও কোথায় বলব এই কার্যকারণ অনুষঙ্গ অনিবার্য হয়ে পড়ে একজন অক্ষর শিল্পীর কাছে। ভবানীপ্রসাদ মজুমদার দীর্ঘ সময়ের এমন একজন ছড়াকার যাঁর যে-কোনো সময়ের একটি ছড়া পাঠ করলে শুধু মানসিক আত্মপ্রসাদ নয়আমাদের শিখনের একটি ধরতাই অজান্তে মাথায় গেঁথে যায়। সেদিক দিয়ে তিনি একটি প্রকরণ বেছে নিয়ে যে এসব লিখছেন ঠিক তাই নয়অথচ শব্দের কূটকচালি দিয়ে আমাদের প্রতিদিনকার পড়ে পাওয়া শব্দগুলিকেই লেখার খাতায় জব্দ করে দিচ্ছেন। তাতে তাঁর যেমন একটি আনন্দের উল্লাস খেলে যাচ্ছে সারা শরীরেতেমনই আমরা যারা পড়ছি তারা ভাবছি, ‘এভাবে তো কেউ আগে বলেনি’, কিংবা ‘এভাবেও তাহলে বলা যায় এই যে আত্মতৃপ্তি। পঠনের আনন্দধ্বনি যা বেজে যায় ভাবনার অনুগত সত্তার গভীরে তা শুধু হেলাফেলা নয়অনেক গুরুগম্ভীর বিষয়ের সহজিয়া প্রক্ষেপণ তাঁর সমাজ ভাবনাকেই প্রতিবিম্বিত করে নন্দিত হয়

 

সুকুমার রায়ের ‘পাগলা দাশু’ পড়ে রবীন্দ্রনাথ মন্তব্য করেছিলেন—সুকুমারের লেখনী থেকে যে অবিমিশ্র হাস্যরসের উৎসধারা বাংলা সাহিত্যকে অভিষিক্ত করেছে তা অতুলনীয়। তার সুনিপুণ ছন্দের বিচিত্র ও সচল গতিতার ভাব-সমাবেশের অভাবনীয় অসংলগ্নতা পদে পদে চমৎকৃতি আনে।

এই যে ‘চমৎকৃতি’ অথচ ‘ভাব-সমাবেশের অসংলগ্নতা’ দুই ভিন্নধর্মী উপাদান সুকুমারের ছড়ায় যেমন অজস্র ছড়িয়ে আছেতেমনই তার অর্থবৈগুণ্য অপেক্ষা ‘কুমড়োপটাশ’-এর মজাদার দাক্ষিণ্য যেন সাহিত্যে এক আলাদা জগৎ তৈরি করেছে। ভবানীপ্রসাদ মজুমদারের ছড়াগুলি পড়লে উদ্ভট অদ্ভূতুড়ে অর্থবাহী উপাদান অনেক খুঁজে পাওয়া যাবে তা নয়তবুও তিনি সম্পূর্ণ নিজস্ব আঙ্গিকে ছড়া রচনার পরিচিতি সত্তায় নিজেরই একটি সিভি রচনা করেছেন। যেমন, ‘দাদাদের তো চিন্তাই নেই রোজগার আর রুজির/ কুঁজো হয়েই পুজো করেন পুঁজিপতির পুঁজির’ (বললে হবেখরচা আছে!)। এখানে আগডুম-বাগডুম শব্দ বা বাক্যের চিৎকার না বাড়িয়ে তিনি একটি গভীর দশক নিরপেক্ষ চিন্তনের গোড়ায় জল দিয়েছেন। এখানে কৌতুক পরিবেশনের ইচ্ছা যেমন ছড়াকারের নেই তেমনই ছন্দ ও অন্ত্যমিলের সরল প্রয়োগে ছড়াটি আদ্যোপান্ত জায়মান হয়ে উঠেছে। সঙ্গে সঙ্গে ভবানীপ্রসাদ আমাদের কানে কানে যেন শুনিয়েছেন যেহেতু আমরা যোগীন্দ্রনাথের ‘পাখিসব করে রব রাতি পোহাইল/ কাননে কুসুমকলি সকলি ফুটিল’-র সময় থেকে বিস্তর দূরত্বে অবস্থান করছিতাই সময়ের নিরিখে যে আর্থ-সামাজিক অবনমন নিয়ত দীর্ণ করছে সমাজ সভ্যতা। যেখানে জীবনধারণ ও ভাবনার মধ্যে আসমান-জমিন ফারাক ঘটে গেছে তার প্রতিফলন সাহিত্যের আঙিনায় অবশ্যই ছাপ রাখবে পুরাতনকে মননে রেখে। ছড়ার চিরত্ব অথবা ‘জাতীয় সম্পত্তি’-র যে আবশ্যক গুণপনা যা তার ঐতিহাসিকতাকে স্পষ্ট করেতেমনই জীবিত থাকার শর্তে কানে বাজা ও প্রাণে লাগার আত্মশ্লাঘায় ছড়াকার একটি দায় পালন করছেন এ-কথা বলাই যায়। রবীন্দ্রনাথ যে কারণে ছড়াকে ‘জাতীয় সম্পদ’ বলছেন তাতে সম্পত্তির ভোগদখল অপেক্ষা তাকে সংরক্ষণের আবদারই ঝরে পড়েছে। ভবানীপ্রসাদ যখন তাঁর ‘কাদের তরে লিখছ দাদা?’-য় লেখেন—

পাঁচতলাতে নয়কো যারাগাছতলাতেই থাকে
তোমার কলম তাদের ব্যথার একটু কি খোঁজ রাখে?
ডুবছে যারা জটিল-জীবন চোরাবালির পাঁকে
তাদের চোখের জলে কজন চালচিত্তির আঁকে?’

     ছড়ার নামকরণেই ভবানীপ্রসাদ তাঁর অব্যর্থ ইঙ্গিতটি দিয়ে রেখেছেন। এখানে ছড়ার অন্ত্যমিল কার্নিকে তিনি এমন কলকা খাঁটিয়ে রেখেছেন যা আমাদের সর্বজনীন জিজ্ঞাসাঙ্গকে এতটুকু নড়তে দেয় না। প্রশ্ন ওঠেছড়ার যে চিরায়ত রস তার কি কোথাও এতটুকু খামতি লক্ষ করা যাচ্ছে এখানে। উত্তর অত্যন্ত স্বাভাবিক যেশব্দ ও কথনভঙ্গির মুন্সিয়ানায় অতি সহজ আটপৌরে চিন্তনের মাঝে একটি বৃহত্তর প্রশ্ন তিনি আমাদের করে বসেছেন। অক্ষরজীবীদের যা অবশ্যই ভাবাবে। ইচ্ছেমতো ‘চালচিত্তির’ আঁকা যেমন সৃষ্টিশীল মানুষের রঙ ব্যবহারের ঐশ্বর্য। আবার শিল্পীকেই ভাবতে হয় তার সংরক্ষণ আগামী কেমনভাবে করবে। মনে আসা স্বাভাবিক অন্নদাশংকরের ‘খুকু ও খোকা’-র কথা—তোমরা যেসব বুড়ো খোকা ভারত ভেঙে ভাগ করো/ তার বেলা?’ এই যে সর্বজনীনতা তাকে অগ্রাহ্য করবে কেএ-ছড়াও যেমন জাতীয় সম্পত্তিভবানীপ্রসাদেরও অজস্র এ-জাতীয় ছড়া আছে যার মান্যতা জাতীয় সম্পদের কাছে। সিরিয়াস ছড়ার মধ্যে অজানিতে একটি নিজস্ব ভাবনা যখন প্রকাশিত হয় তখন তার ঠিক উলটোদিকে মনের নিয়ন্ত্রণকে বাগে আনার জন্য ছড়াকারকে কিছু চটজলদি লেখাও লিখতে হয়। তাতে মোক্ষম চাল থাকে না। কিন্তু হালকা পালকের মতো ভাসতে থাকে সে-সব ভাবনা। ভবানীপ্রসাদের ‘ভারতীয় ক্রিকেটের জাতীয় সংগীত’ ছড়াটিও সেরকম—হও বোলিংয়েতে বোলিং বীর/ হও ব্যাটিংয়েতে ধীর,/ হও ফিল্ডিংয়েতে স্থির নাহি ভয়।’ ভারতীয় ক্রিকেটের এক কঠিন সময়ের কথা এতে উঠে এসেছেকিন্তু তার বেশি কিছুর সন্ধানে কেউ ব্রতী হলে নিরাশ হতে হবে সন্দেহ নেই। বিশ হাজারের ওপর ছড়ার ছটরা যাঁর হাত দিয়ে বেরোতে পারে এবং এখনও সমানে বেরোচ্ছেতাঁকে কোনও বয়সের সংখ্যায় বাঁধতে যাওয়া বাতুলতা। ভিন্নধর্মী শুধু বললে হবে নাভিন্ন আঙ্গিক ও মননের যাবতীয় উপাদান পাওয়া যাবে তাঁর ছড়ায়

  

ছড়া সাহিত্যের সলতে পাকানোর মূলে লিমেরিকের যে হদিস মেলে তা দুশো বছর (১৮২০) পেরিয়ে গেছে। প্রাচীন এই সৃষ্টিকর্মের সংগ্রহ গ্রন্থ সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে। ১৮২০-এর পঁচিশ বছর পর (১৮৪৬) এডওয়ার্ড লিয়র-এর Book of Nonsense’ প্রকাশিত হয়। তখন থেকেই ছড়া লেখার প্রবণতা চারিয়ে যায়। এডওয়ার্ড লিয়রের সঙ্গে সমানভাবে উচ্চারিত হতে থাকে লুইস ক্যারলএডওয়ার্ড গোরি,আর্নল্ড বেনেট প্রমুখের নাম। বাংলায় উদ্ভট ছড়ার শুরু হয় সুকুমার রায়ের হাতে। সেদিক থেকে দেখলে ছড়ার প্রাচীনত্ব নিয়ে কোনও কথাই চলে না। দশকভেদে এর বিবর্তন ঘটেছে যেমন-তেমনই গ্রামবাংলার নানা লৌকিক উপাদানউৎসবআচার-অনুষ্ঠানে মুখে মুখে ছড়া কাটার যে রেওয়াজ চালু ছিল তার থেকেও নানা সমৃদ্ধ উপাদান সংযুক্ত হয়ে একটি পরিপূর্ণ অবয়ব পেয়েছে। রবীন্দ্রনাথ যথার্থভাবেই বলেছেন, ‘… তাহার বক্তব্য যখন ফুরায় তখনো তাহার ঝংকারটা ফুরায় না…।’ ঝংকারের সঙ্গে শৈলীর একটা চিরন্তন গাম্ভীর্য রয়েছে। আবার তার স্থায়িত্ব বা চিরত্ব যাই বলি না কেন তা কিন্তু বিচিত্রধর্মী। স্থান-কাল-পাত্রভেদে ছড়ার আনুষ্ঠানিকতা ভিন্নতা পায়। রবীন্দ্রনাথের ‘ছেলে ভুলানো ছড়ায় যখন দেখি—ওপারেতে কালো রংবৃষ্টি পড়ে ঝমঝম/ এপারেতে লঙ্কাগাছটি রাঙা টুকটুক করে/ গুণবতী ভাই আমার মনকেমন করে।’ তখন ‘গুণবতী ভাই’-এর তলায় একজন পরীক্ষক ভুল হয়েছে বলে দাগা দিতেই পারেন। ভাই আবার গুণবতী! লিঙ্গ তো ব্যাকরণসিদ্ধ হল না। এখানেই শৈলীর ব্যাখ্যা চলে আসে। যদি ‘গুণবান ভাই’ বলে ওই লাইনটি বার বার আওড়ানো যায় তাহলে দেখা যাবে ছড়ার মাধুর্য সর্বোপরি ছন্দে কম পড়ছে এবং তা মান্যতা পাচ্ছে না। ভবানীপ্রসাদ যেমন ‘রঙবদলের ব্যাপার-স্যাপার’ ছড়ায় লিখছেন—পরদিন কী ঘটল ব্যাপার/ বলছি শোন দাদা!/ সাবান খেয়েই কালো হাতির/ বাচ্চা হল সাদা!’ এখানে দুটি বিস্ময়চিহ্নে একটি অসম্ভব সম্ভবনাকে ছড়াকার ইঙ্গিতে বুঝিয়েছেন। ভাবনার দিক দিয়ে উদ্ভট কুশলতা দিয়ে একটি কৌতুকরস পরিবেশনই ছড়াকারের উদ্দেশ্য। কানে বাজা ও মনে তার দীর্ঘস্থায়ী ছাপ রেখে যাওয়াই এ-ছড়ার আসল উপলক্ষ্য। এখানে অর্থের বা প্রাসঙ্গিক-অপ্রাসঙ্গিকের দোহাই পাড়লে বিসমিল্লায় গলদ। আবার তাঁর ‘ঐতিহাসিক জলসা’ ছড়াটিকে যদি পড়া যায়—তিনদিন তিনরাত গালে ঠেসে পান-/ জোর গান গেয়েছিল চেঙ্গিস খান!’ এখানেও অর্থ পরম্পরা অপেক্ষা মনোরম অন্ত্যমিলে নিপাট পঠনের আনন্দ যেন উড়ু উড়ু মেঘের মতো ভেসে বেড়ায়। ভবানীপ্রসাদ মজুমদারের এ-জাতীয় ছড়া হাজার ছাড়িয়ে যাবে তাতে সন্দেহ নেই

আবার সিরিয়াস ছড়ায় তিনি বেশ দড়। একটা সময় যখন বাংলা ভাষার রাষ্ট্রীয়করণ এবং তাকে প্রতিদিনকার কাজের ভাষা হিসাবে প্রশাসনিক দপ্তর বা আইন-আদালতে প্রয়োগ করা নিয়ে নানাভাবে লিখন ও বলন চালু হল বাংলা ভাষার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির দোহাই দিয়ে এবং আবশ্যকভাবে বিজ্ঞান ছুঁয়ে তখন ভবানীপ্রসাদও সেই অভিমুখে চালনা করলেন তাঁর কলমকে। বাংলাকে বাদ দিয়ে যখন ইংরেজির প্রাধান্যকে গুরুত্ব দিয়ে নানা স্তরে ভাবনা শুরু হল এবং অভিভাবকদের মধ্যে একপ্রকার অসুস্থ প্রতিযোগিতা ইংরেজি মাধ্যমের দিকে অহেতুক (!) ঝুঁকে পড়ার প্রবণতা বাড়িয়ে তুললতখন এক একুশে ফেব্রুয়ারিতে তিনি লিখলেন—একুশ মানেই একটা ছবি রক্তে-ভেজা সড়কের / একুশ মানেই প্রতিষেধক বাংলা-ভাষার মড়কের এখানে যেমন টানটান ছন্দ আছেতেমন আছে চাবুক! একটি ভাষার জন্যে রাজপথে রক্ত ঝরছেশহিদ হচ্ছে। আবার সেই ভাষাকে অবহেলিত হতে হচ্ছে প্রয়োগকারীদের হাতে। মড়কের প্রতিষেধক যেমন উপশমআরোগ্যসেরকমই ‘বিনা স্বদেশী ভাষা মিটে কি আশার সাবালকত্বে কথা বলার আশ্চর্য  প্রতিষেধক বাংলা ভাষা। মনস্তাত্ত্বিক দিক দিয়েও যার মান্যতা বিজ্ঞান ছুঁয়েছে। বিষয়টি নিয়ে একাধিক কবিতা ভবানীপ্রসাদের হাত দিয়ে বেরিয়েছে সত্যকিন্তু সবচেয়ে ব্যতিক্রম লেখা তাঁর ‘বাংলাটা ঠিক আসে না’ ছড়াটি। একদিক দিয়ে আদ্যন্ত সিরিয়াসঅন্যদিক দিয়ে আমাদের ইংরেজি প্রীতির যে ভড়ংতাকে তিনি সহজ সরল শব্দ ও ভাব-গরিমায় বাঙ্ময় করে তুলেছেন। এই একটি মাত্র ছড়া লিখে তিনি সার্বিক ভাবনার গণ জমায়েত সংগঠিত করেছেন। তিনি যখন লেখেন—ছেলে আমার খুব সিরিয়াস কথায় কথায় হাসে না/ জানেন দাদা আমার ছেলের বাংলাটা ঠিক আসে না’ তখন একটি সামগ্রিক বোধকে অস্বস্তির অঙ্গারে তিনি জারিত করেন। পরীক্ষিত এই ভাবনায় সমৃদ্ধ তিনি যেন একটি আন্দোলনের সূচিমুখ স্থির করে দেন পরোক্ষে। আরও আলোচনার বিষয় ছড়াটির জনপ্রিয়তা নিয়ে। লেখাটি প্রকাশিত হওয়ার পর লক্ষ মুখে যেমন এর আবৃত্তি উচ্চারিত হয়েছেতেমন এমন কোনও ছোটো-বড়ো প্রতিযোগিতার আসর বাদ যায়নি যেখানে বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত হয়নি। এছাড়া বিশিষ্ট আবৃত্তিকারদের কণ্ঠে ধরা রয়েছে তাঁর এই ছড়া। আসলে তাঁরই লেখায়—যে ছড়া ভরায় ভলোবাসা/ যে ভাষা ছড়ায় স্বপ্ন খাসা’—তারই অনুরণিত সত্তার গভীরে আমাদের ‘কান্না হাসির দোল-দোলানো পৌষ ফাগুনের মেলা আবার ভবানীপ্রসাদের ‘স্বপ্ন গেছে চুরি’ ছড়াটির কথা যদি ধরা যায় সেখানেও শিশুর শৈশবের যে আকাঙ্ক্ষাস্বপ্নএক্কা-দোক্কা খেলা বা কেটে আসা ঘুড়ি ধরা অথবা ফড়িংয়ের পিছু পিছু ছুটে বেড়ানোবৃষ্টিতে শপশপে ভেজার আনন্দ শরীরে জড়িয়ে নেওয়া তার সবকটি আনন্দ থেকে বঞ্চিত একটি শিশুর স্বপ্ন চুরি হয়ে গেলে তার যাবতীয় আনন্দ হেরে বসে থাকে ব্যবস্থার কাছে। তখনই তিনি লেখেন—স্কুলে পড়াবাড়িতে পড়াপড়া কোচিং ক্লাসে/ চোখ ঢেকে যায় লেন্স চশমায় প্লাস মাইনাস গ্লাসে/ ‘নেই দেরি আরচাই কেরিয়ার’ বাবার জারিজুরি/ স্বপ্ন গেছে চুরি আমারস্বপ্ন গেছে চুরি।’ নিজে একজন শিশুদের শিক্ষক হওয়ায় শিশুর মনস্তত্ত্বতার ভালোলাগা মন্দলাগাগুলোকে অনুভব করতেন তিনি। শিশুর শ্রেণি পঠনের বাইরে ও তার যে নিজস্ব জগৎ আছে যার একচ্ছত্র আধিপত্য তার নিজস্ব মননের কাছে। তাকে বাদ দিলে আর সবকিছু অসম্পূর্ণ থেকে যায়। আমাদের গম্ভীর অভিভাবক সমাজকে রিয়ার-কেরিয়ার করে যে ভুলটি করে বসছে। নম্বর-সর্বস্ব শিক্ষাব্যবস্থার শিকার আজকের শিশুরা

ভবানীপ্রসাদের সাহিত্য রচনা শুরু ষাটের মাঝামাঝি থেকে। জন্ম ১৯৫০ সালের ৯ এপ্রিল হাওড়ার শানপুরে। পেশায় শিক্ষক তিনি নিজের জীবনের একটি স্মরণীয় মুহূর্তের কথা প্রায়শই বলে থাকেন১৯৮৮ সালে সুকুমার রায়ের নামাঙ্কিত শতবার্ষিকী স্বর্ণপদক সত্যজিৎ রায় নিজের হাতে পরিয়ে দিয়েছিলেন তাঁকে। জীবনভর নানা পুরস্কারে ভূষিত তিনি জীবনকৃতি পুরস্কার পেয়েছেন ছোটোদের কাছ থেকে। সত্তরোর্ধ্ব মানুষটির হাত দিয়ে এখনও সমানে বেরোচ্ছে বিচিত্র-মনস্ক ছড়া। শারীরিক সমস্যার ঊর্ধ্বে সৃষ্টির অনুমুখে তিনি এক সৃষ্টি-পাগল কিশোর। রামধনুর ঐশ্বর্যে দীপ্তমান তাঁর লেখন। ছন্দে-ছড়ায় মুক্ত তিনি আপনভোলা জাদুকর

 

<
সূচিপত্র