বড় গল্প - ১ (রহস্য) । জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১



 চন্দ্রগিরিকেল্লার রহস্য











সৌম্যনারায়ণ আচার্য 
দশরহল্লি, ব্যাঙ্গালোর




 

আমি চলেছি তিরুপতি শহর থেকে চন্দ্রগিরি কেল্লার দিকে। জায়গাটা বিখ্যাত তীর্থস্থান তিরুপতি শহর থেকে মাত্র ষোল কিলোমিটার দূরে একটা ঐতিহাসিক জায়গা। একসময় ছিল বিজয়নগর সাম্রাজ্যের প্রাদেশিক রাজধানী। এখানে আছে প্রায় হাজার বছরের পুরোনো দুটো কেল্লা। যা বানিয়েছিলেন নরসিংহ যাদবরায়া নামক যাদব বংশের এক রাজা। এই যাদব বংশ দক্ষিণ অন্ধ্র প্রদেশ শাসন করত। আমি এখানে এসেছি একটা প্রত্নতাত্বিক খননের জন্য। যা কেল্লার ঠিক পশ্চিম কোণে শুরু হয়েছে। তোমরা যারা জানো না তাদের বলি যেআমার নাম শ্রীকমলেশ্বর দত্ত। পেশায় আমি এক ইতিহাসের অধ্যাপকপুরুলিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াই। আমার গবেষনার বিষয় ছিল পল্লব যুগের সমাজ ব্যবস্থা। আর তারজন্য আমাকে তামিলনাডু বেশ কয়েকবার আসতে হয়েছে। যেতে হয়েছে পল্লবদের রাজধানী কাঞ্চীপুরম। যদিও আমি ইতিহাসের অধ্যাপক তবুও আমার নেশা হল প্রত্নতত্ব বা আরকেওলজি। ভারত এমন একটা দেশ যেখানে এখনও মাটির তলায় চাপা পড়ে আছে হাজার হাজার বছরের নিদর্শনযা খননের ফলে আমরা প্রায়ই খুঁজে পাই। কিন্তু খোঁজার কি আর শেষ আছেআরো অনেক তথ্যনিদর্শন চাপা পড়ে আছে। চন্দ্রগিরির কেল্লাতে ও তার আশেপাশের জায়গাগুলোতে প্রচুর খনন হয়েছে ও অনেক প্রাচীন মূদ্রামূর্তিঅস্ত্র শস্ত্র আবিস্কৃত হয়েছে। আর গত সপ্তাহ থেকে আবার খননের অনুমতি পাওয়া গেছেআর এবার কেল্লার পশ্চিম কোণায় খোঁড়াখুঁড়ি শুরু হয়েছেতাই আমাকে ডাকা হয়েছে। ডেকেছেন অন্ধ্রপ্রদেশের রাজ্য প্রত্নতত্ব বিভাগের প্রধান শ্রীরাজেশ্বর রেড্ডি। উনি আমাকে চেনেন। ওঁর সাথে আমার আলাপ হয়েছিল এক ইতিহাসের সেমিনারে কলকাতায়। তখন উনি আমার লেখা বইয়ের উল্লেখ করেছিলেনআর বলেছিলেন যেভবিষ্যতে আমার সাথে কাজ করতে চান। যদি কখনও সুযোগ হয় তো আমাকে উনি ডাকবেন। আমি বলেছিলামনিশ্চয় আসবআমি সবসময় প্রত্নতাত্ত্বিক খননের সময় উপস্থিত থাকতে ভালোবাসিওতে অনেক কিছু শেখা যায়। সেরকমে কোনো কিছু ঘটনা ঘটলে আমাকে অবশ্যই জানাবেন

        তারপর থেকে ওঁর সাথে আমার যোগাযোগ রয়েছে। আর গত সপ্তাহেই উনি আমাকে এই চন্দ্রগিরিকেল্লায় খননের সময় উপস্থিত থাকতে বলেন। কারণওঁর ধারণাআমার শিক্ষা অনুসারে আমি ওঁদের অনেক সাহায্য করতে পারব। তাই আমি গতকালই তিরুপতি এসেছি। রাতটা ওখানে একটা হোটেলে কাটিয়ে আজ সকাল সকাল চন্দ্রগিরির উদ্দেশ্যে চলেছি। তিরুপতি থেকে এঁর দূরত্ব মাত্র ষোল কিলোমিটার। চন্দ্রগিরির ছোট্ট বাজার এলাকা পেরিয়েই একটু পরেই আমার গাড়ি চন্দ্রগিরিকেল্লার দিকে চলল। আমি দূর থেকেই কেল্লার উঁচু চুড়োটা দেখতে পেলাম। আর ডানদিকে বেঁকে খুব সহজেই কেল্লার মুল প্রবেশপথের সামনে এসে পড়লাম। আমার গাড়ি ওখানে দাঁড়াতেই গেটের সামনে মজুদ নিরাপত্তারক্ষী এগিয়ে এল। আমি গাড়ি থেকে নেমে আমার ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে ড্রাইভারকে ভাড়া দিয়ে নিরাপত্তারক্ষীর সাথে কথা বললাম। সে তখন নিজের মোবাইলে রাজেশ্বর রেড্ডির সাথে যোগাযোগ করল। কথা বলার পরে গেটটা খুলে দিয়ে বলল“আপনি ভেতরে যেতে পারেন।”

আমি ওকে “ধন্যবাদ” দিয়ে ভেতরে যেতেই রাজাদের আমলের পাথরের নিরাপত্তারক্ষীদের জন্য তৈরি মন্ডপের কাছেই রাজেশ্বরকে দেখতে পেলাম। ও আমাকে দেখে হাসিমুখে এগিয়ে এসে করমর্দন করল। বলল“আসুন। আপনার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। চলুনআগে ক্যাম্পে একটু বিশ্রাম করুন।”

না-না। একদম বিশ্রামের দরকার নেই। আমি রাতের বেলায় খুব ভালো ঘুমিয়েছি। এখন শরীর এক্কেবারে ঝরঝরে। চলুন খননের স্থলে যাই।”

ঠিক আছেচলুন।” রেড্ডি বলল। আমি ক্যাম্প বা তাঁবুতে আমার জন্য বরাদ্দ জায়গায় ব্যাগটা রেখে দিয়ে ওঁর সাথে কেল্লার পাশ দিয়ে খননের স্থলে চললাম। বিশাল এই জায়গায় আছে দুটি কেল্লারাজামহল ও রানিমহল। শুরুতেই আছে রাজামহল ও তারপরে রানিমহল। রাজামহলটি বর্তমানে একটি সংগ্রহশালায় পরিণত। আর আছে তিনটে সুন্দর মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ। সেগুলো পেরিয়েই পাহাড়ের পাদদেশেঅর্থাৎ কেল্লার প্রাচীরের প্রান্তে চলছে খনন। সেখানে আলাপ হল তিরুপতির বিখ্যাত প্রত্নতাত্ত্বিক শ্রী যোগেশ  কুমারের সাথে। মিঃ কুমার গত তিন দিন ধরে এখানে রয়েছেন। উনি আমাকে স্বাগত জানালেন। বললেন“আপনি আসাতে আমরা খুবই খুশী। রাজেশ্বরের মুখে আপনার কথা শুনেছি। বিভিন্ন পত্রিকায় আপনার লেখা পড়েছি। পল্লবদের নিয়ে আপনি যা লিখেছেন তা আমার খুবই ভালো লেগেছে। এবার আপনি দেখুন আমাদের এখানে কি কি পাওয়া যায়।”

আমি ওঁদের সাথে খননের জায়গায় দৃষ্টিপাত করলাম। এখানে যে একটা স্টোররুমের মতো ছিল তা বোঝাই যাচ্ছে। এর ঠিক বাঁ দিকে একটা ভাঙ্গা বাড়ির মতো দেখাচ্ছে। আমি সেদিকে তাকাতেই মিঃ কুমার বললেন“ওটা ছিল একটা অস্ত্রাগার। আসলে পাহাড়ের দিক থেকে কেউ আক্রমণ করতে পারবে না এই ভেবেই রানিমহলঅস্ত্রাগার ও স্টোররুম বা গুদামঘর এদিকে বানানো হয়েছিল।”  হ্যাঁ,  তোমাদের বলাই হয়নি যেএই কেল্লাটি চন্দ্রগিরি পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত। চাঁদ উঠলে তা পাহাড়ের পেছন থেকেই ওঠেতাই এর নাম চন্দ্রগিরি। রাতের বেলায় চাঁদ উঠলে দারুণ দেখায়। এখানের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অপরিসিম। আমি অস্ত্রাগারটা একবার ভালো করে দেখে নিয়ে আবার খননের দিকে এগিয়ে গেলাম। এখন চারটে বড় ঘর দেখা যাচ্ছে। তার মধ্যে একটা বাড়ি ভালো করে পরিস্কার করা হচ্ছে। কিন্তু এখনো দ্রষ্টব্য কিছু পাওয়া যায়নি। আমি একটা বেতের চেয়ারে বসে পড়লাম ও মোবাইলে কয়েকটা ছবি তুললাম। এখানে আজই পাওয়া গেছে একটা ধাতুর লিপি। ধাতুটা কি তা এখনও বোঝা যায়নি। তবে ওটা সোনার বলেই মনে হচ্ছে। আর কাল একটা তাম্রলিপি পাওয়া গেছেযেটা কেল্লার দোতলায় রাখা আছে। ওই লিপি দুটো গুদাম ঘরের একটু কাছে ওই মন্দিরে পাওয়া গেছে  

একটু পরেই শাবলে মাটি খুঁড়তেই “ঠং” করে একটা শব্দ পাওয়া গেল। তখন সেই শ্রমিককে সাবধানে জায়গাটা খুঁড়তে বলা হল। তাঁকে এই কাজে সাহায্য করতে এগিয়ে এল আরো দুজন শ্রমিক। তারা মাটি সরাতেই দেখা গেল একটা বড় সিন্দুক। কি দিয়ে তৈরিতা বোঝা গেল না। তবে ওটা যে বেশ ভারি তা বোঝা গেল। তিনজন কর্মী ওটা ধরাধরি করে আমাদের সামনে এনে রাখল। তারপর ওঁরা আবার নিজেদের কাজে ফিরে গেল। তখন রাজেশ্বর ও কুমার দুজনে ওটা কি ভাবে খোলা যায় তাঁর চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু ওঁরা অনেক চেষ্টা করেও ওপরের ঢাকনাটা খুলতে পারল না। তবে ওটার ওপরে যে আছে শিব ঠাকুরের বাহন নন্দীর খোদিত মূর্তিতা দেখা গেল। ওটা দেখে মিঃ কুমার আমাকে শুধোলেন“এটা কিসের ইঙ্গিত করছে মিঃ দত্ত?

“ঠিক এরকম মূর্তি আমি পল্লবদের একটা সিন্দুকে দেখেছি ও ওদের সময়কার কিছু মূদ্রায় দেখেছি।” আমি বললাম

“তারমানেএটিও পল্লবদের সময়কার? রাজেশ্বর শুধোল

“হতে পারে। কিন্তু যাদবদের কেল্লায় পল্লবদের সিন্দুক কিভাবে পাওয়া যেতে পারে?

“দেখুনযাদব আর পল্লবরা প্রায় সমসাময়িক। যাদবরা একটু আগের। আর সেসময় এক রাজ্যের মূদ্রা অন্য রাজ্যেও চলতবিশেষ করে বানিজ্যে। অনেক সময় এক রাজ্যের রাজারা অন্য রাজ্য জয় করত তখন আগেকার সাম্রাজ্যের মূদ্রা ব্যবহার করত। তাই যখন পল্লবরা এই অঞ্চল শাসন করছিল তখনও তারা এই কেল্লার দখল নিয়েছিল আর এখানে গুদাম বানিয়েছিল। পরে অর্থাৎ ১৩৬৭ খ্রিষ্টাব্দে যখন সঙ্গম বংশের সম্রাটরা এই অঞ্চল জিতে নেন তখন তাঁরা এই কেল্লাটির দখল নিয়েছিলেন কিন্তু হয়তো এই গুদামটি খুঁজে পাননি। তাই আমরা এতদিনে এটা খুঁজে পেলাম।” যোগেশ কুমার বললেন    

কিন্তু ওই সিন্দুকটা কিছুতেই খোলা যাচ্ছিল না। তাই ওটা পরিস্কার করে রাখা হল। আমার খুব ইচ্ছে হল যেওটা খুলে দেখার। কিন্তু ওটার ঢাকনাটা ভালো ভাবে এঁটে বসে গেছে। আমি ওটার কাছে গিয়ে খুব ভালো ভাবে দেখতে লাগলাম। দেখতে দেখতে আমি একটা ছোট্ট গর্ত দেখতে পেলাম। গর্তটা দেখে আমার মনে একটা আইডিয়া এসে গেল। আমি মাটি যারা খুঁড়ছিল তাঁদের কাছ থেকে একটা ছোট্ট শাবল নিয়ে ওই গর্তটাতে ঢুকিয়ে একটু চাপ দিতেই ঢাকনাটা খুলে গেল। আর তক্ষণই সবাই আমার কাছে চলে এল। আমি দেখতে পেলাম ওটার মধ্যে আছে অনেকগুলো স্বর্ণ পত্র ও একটা তাম্রপত্র। যেগুলোর গায়ে খোদাই করে কিছু লেখা আছে। একটা সোনার পাত হাতে নিয়ে রাজেশ্বর বললেন“এটা মনে হচ্ছে প্রাচীন তেলুগু ভাষায় লেখা। মিঃ কুমার ওই ভাষা ভালো করে পড়তে পারেন।”

মিঃ কুমার তখন সোনার পাতটা হাতে নিয়ে বললেন“এতে লেখা আছেউপেন্দ্র রায়া এখানে এসেছিলেন ও উনি সালুভা সাম্রাজ্যের ক্ষমতা দখল রুখে দিতে চেয়েছিলেন। এছাড়া লেখা আছে সঙ্গম সাম্রাজ্যের শেষ সম্রাট প্রৌঢ় রায়াকে সরিয়ে ক্ষমতা দখল করেন সালুভা নরসিংহ দেবারায়া। উনি সালুভা বংশের পত্তন করেন। ছয় বছর রাজত্ব করার পরে ওঁর বড় ছেলে তুম্মা ভূপালা সম্রাট হনকিন্তু সঙ্গম সাম্রাজ্যের অনুগত এক আততায়ীর আক্রমণে উনি নিহত হবার পরে ওঁর ছোট ভাই দ্বিতীয় নরসিংহ সম্রাট হন। কিন্তু দ্বিতীয় নরসিংহকে হত্যার ষড়যন্ত্র সবাই জানতে পারে। ওঁদের এক কাকাতো ভাই ব্যপারটা জানতে পেরেছিলতাই তাঁকে এখানে বন্দি করে রাখা হয়েছিলসাথে তাঁর কয়েকজন অনুগামীকেও বন্দি করা হয়েছিলকিন্তু তিনি সপরিবারে একদিন এখান থেকে পালিয়ে গিয়ে আত্মরক্ষা করেন। কিভাবে তা আজও জানা যায়নি।”

“কিন্তু দ্বিতীয় নরসিংহকে তো রক্ষা করা যায়নি। আসলে ওঁর সেনাপতি তুলুভা নরসা নায়কর মৃত্যুর পরে তাঁকে রক্ষা করা আর কেউ ছিল নাতাই পেনুনকোন্ডায় এক রাত্রে উনি নিহত হন আর তারপরে তুলুভা বীরা নরসিংহ রায়া ক্ষমতা দখল করেন ও নিজেকে বিজয়নগরের সম্রাট বলে ঘোষনা করেন। তাঁর পুত্র কৃষ্ণদেবারায়া ছিলেন এক শক্তিশালী সম্রাটযিনি পুরী পর্যন্ত দখল করেছিলেন ও পুরীর রাজাকে বন্দি করে এনেছিলেন। কিন্তু কে এই কাকাতো ভাইযাকে বন্দি রাখা হয়েছিলউনিই কি উপেন্দ্র রায়া? আমি প্রশ্ন করি

“সত্যিএই নামটা আমিও আগে শুনিনি। এখন দেখি শেষাগিরি রাও যদি কিছু বলতে পারেন।” রাজেশ্বর বলল

মিঃ শেষাগিরি রাও হলেন তিরুপতির শ্রীভেংকটেশ্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের প্রাক্তন অধ্যাপক। অবসর নিয়ে এখন উনি তিরুপতিতেই থাকেন। আর নানান পত্রিকায় লিখে থাকেনখুবই পন্ডিত লোক। আমারও মনে হলউনি হয়তো কিছু বলতে পারবেন। যাইহোকরাজেশ্বর ওঁকে একটু পরেই ফোন করবে বলল ও সম্ভব হলে ওঁকে একবার এখানে আসতে বলবে। খোঁড়াখুঁড়িতে আরো অনেক কিছু পাওয়া গেলযার মধ্যে ছিল বিজয়নগর যুগের তামার মূদ্রা। বেলা বাড়ার সাথে সাথে আমরা কেল্লার ভেতরে ঢুকে দোতলায় চলে গেলাম। ওখানে আমাদের খাবার ব্যবস্থা হয়েছে। লাঞ্চ হবার পরে আমরা আবার খননের স্থলে পৌঁছে তা দেখতে লাগলাম। একটু পরে কতগুলো সিল্কের কাপড়ে মোড়া পেতলের প্রদীপ পাওয়া গেল। তারপরে একটা সুড়ঙ্গ দেখতে পেলাম। সুড়ঙ্গের মুখ মাটি দিয়ে ভরাট করা আছে। যোগেশ কুমার ওই মাটি সরাতে বারণ করলেন। বললেন“ওই দিকটা পরে দেখা যাবে।”

আমরা তখন ওই কাপড় ও প্রদীপগুলো হাতে নিয়ে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলাম। কাপড়ে প্রাচীন তেলুগু ভাষায় কিছু লেখা ছিল। কিন্তু দীর্ঘদিন মাটির তলায় চাপা পড়ে থাকার দরুন তা অস্পষ্ট হয়ে গেছে। রাজেশ্বর ও মিঃ কুমার দু’জনেই আতস কাঁচ নিয়ে সেই লেখাগুলো পড়ার চেষ্টা করতে লাগলেন। আর ওদিকে শ্রমিকেরা বাঁ দিকটা খোঁড়াখুঁড়িতে ব্যস্ত থাকল। কিন্তু ওখান থেকে ওরা গোটা কয়েক মাটির পাত্র ছাড়া আর কিছু পেল না। একটু পরেই বিকেল হলআমরা চা পান করে আবার খননের স্থলে গেলাম। ততক্ষণে রাজেশ্বররা সেই কাপড়ের লিপির কিছুটা উদ্ধার করতে পেরেছে। ওতে লেখা আছে যেসঙ্গম বংশের শেষ সম্রাট প্রৌঢ় রায়ার স্ত্রীমানে মহারানি চিঠি লিখেছিলেন যেতাঁর স্বামীকে ক্ষমতা থেকে সরানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। তাঁরাই এই পাপ কাজ করতে চায়যারা চায়না সমগ্র দক্ষিণ ভারত দিল্লির বিধর্মী শাসকদের হাত থেকে রক্ষা পাক। উনি লিখেছেন যেএই ঘটনাটা যাতে না হয় তাঁর জন্য প্রাণপণে চেষ্টা করা উচিৎ। উনি আশা করছেন যেওঁর অনুগতরা এই চেষ্টা করবে

“কিন্তু উনি কাকে লিখেছিলেনকাউকে কি সম্বোধন করা আছে?” আমার প্রশ্ন   

“না। সম্ভবত এখানের কোনো সামন্ত রাজাকে উনি লিখেছিলেন। কিন্তু প্রৌঢ় রায়াকে সিংহাসনচ্যুত হওয়া থেকে বাঁচানো যায়নিওঁর এক সেনাপতি সালুভা নরসিংহ দেবরায়াই ওই কাজটা করে সালুভা বংশের পত্তন করেন। আর ওরা সত্যিই দক্ষিণ ভারতকে উত্তর ভারতের সুলতানদের হাত থেকে রক্ষার জন্য কিছু করেছিলেন বলে মনে হয় না। শুধুই ক্ষমতাভোগের জন্যই সঙ্গম বংশকে সরিয়েছিলেন। অথচ দুই যাদব ভাই হরিহর ও বুক্কা কত পরিশ্রম করে ওই অতবড় সঙ্গম সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিল।”

“আর অন্য কাপড়গুলিতে কি লেখা আছে?

“সেগুলো আরো একটু পরে লেখা। তুলুভা বংশের সময় লেখা। এখানে কর কত আদায় করা হয়েছিলকোন কোন অঞ্চলে কর আদায় করা হয়েছিলআর কোথায় নতুন মন্দির বানানো হয়েছে বা পুরনো মন্দিরের সংস্কার করা হয়েছে তার একটা বর্ণনা আছে।” মিঃ কুমার বললেন। এরপরে সন্ধ্যে হয়ে যাবার পরে আমরা কেল্লার সামনের তাঁবুতে ফিরে এলাম। আর ক্যাম্প খাটে শুয়ে শুয়ে আজকের ঘটনার কথা ভাবতে লাগলাম। সারাদিনের ক্লান্তির পরে চোখ একটু বুজে এসেছিলএকটু তন্দ্রা মতো এসেছিল। সেটা ভেঙ্গে গেল রাজেশ্বরের ডাকে। ও বলল“চলে আসুন।”

“কোথায়?

“কেল্লায়। ওপরেযেখানে আমাদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছে।”

“মানেআমরা এখানে থাকব না? আমি অবাক হই

“নাএখানে রাতের বেলায় খুব ঠান্ডা পড়ে। এখন নভেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহ। রাতের বেলায় ওই হিম পড়া অবস্থায় আমরা কাপড়ের তাঁবুর নীচে থাকতে পারব না। তাই কেল্লার দোতলায় আমাদের রাত কাটাতে হবে। আপনার জিনিসপত্র নিয়ে চলে আসুন।”

“তারমানেআমরা রাতের বেলায় ওই হাজার বছরের পুরোনো কেল্লায় শোব। বিশ্বাস হচ্ছে নাশুনেই আমি রোমাঞ্চিত হচ্ছি।” আমি বলি

“ইয়েস স্যর। আমরা ওখানেই রাত কাটাব। এ ব্যপারে কোনো সন্দেহ নেই।” রাজেশ্বর মুচকি হাসে। আমি নিজের ব্যাগ নিয়ে ওঁকে অনুসরণ করি। এক হাজার বছরের পুরোনো চন্দ্রগিরির কেল্লার ‘রাজামহলে’ প্রবেশ করে সংগ্রহশালার পাশ দিয়ে ডানদিকের পাথরের সিঁড়ি দিয়ে চড়ে দোতলায় পৌঁছে একটা টেবিলে নিজের ব্যাগটা রেখে তারপরে বাথরুমে গিয়ে কাপড় বদলে চেয়ারে বসে পড়ি। এটা একটা বিশাল হলঘরের মতো। জানিনা যাদবরাজারা বা তারপরের বিজয়নগরের সম্রাটরা এখানে কি করতেন। তাঁরা নীচের তলায় শুতেন না দোতলায় শুতেন তা হয়তো কোনোদিনই জানা যাবে না। তবে তাঁরা যে নিরাপত্তার ব্যপারে খুব জোর দিতেন তা কেল্লাটা দেখলেই বোঝা যায়। সামনে আছে পাহাড়আর কেল্লার চারদিকে ছিল পরিখানিরাপত্তাপ্রহরীদের মন্ডপ। সামনের পাহাড়ের দিক থেকে কেউ আক্রমণ করতে পারবে নাআর কড়া নিরাপত্তা ভেঙ্গেও কেউ ভেতরে ঢুকতে পারবে না। আর আগেকার দিনে অনেক দূর থেকে পাহারা থাকত 

“এখন একটু বিশ্রাম করুনআজকের কাগজটাও পড়তে পারেন।” বলে সেদিনের খবরের কাগজটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিলেন রাজেশ্বর। আমি সেটা হাতে নিয়ে পড়তে লাগলাম। তিরুপতি থেকে প্রকাশিত এই পত্রিকার ভেতরের পাতায় আমাদের এখানের খননের কথাও লেখা হয়েছে ছবি সমেত। দেখে খুবই ভালো লাগলো। একটু পরেই খাবার এসে গেল। এখানের খাবার আছে তিরুপতির এক হোটেল থেকে। ততক্ষণে মিঃ কুমারও এসে গেছেন। উনিও বাথরুমে গিয়ে কাপড় বদলে বিছানায় বসে পড়লেন। এখানে নেই কোনো খাবার টেবিল। ছোট্ট টেবিল ও চেয়ার আছে কিন্তু তাতে বসে খাওয়া যায় না। তাই আমরা প্লেটে খাবার নিয়ে বিছানায় বসে খেতে লাগলাম। খাচ্ছি আর ভাবছিএক হাজার বছরের পুরোনো কেল্লার দোতলায় বসে রাতের খাবার খাচ্ছি। খাবার খাওয়া হবার পরে এবার শোবার পালা। এই বিশাল কেল্লার দোতলায় এই লম্বা হলঘরে তিনটে খাটে বিছানা পাতা হয়েছে। দেখে মনে হলএখানে এর আগেও অনেকে রাত্রিযাপন করেছেননাহলে খাটের ব্যবস্থা আছে কি করেএক্কেবারে শুরুর খাটে আমি পরেরটাতে রাজেশ্বর ও শেষের খাটে মিঃ কুমার শোবেন। আমি যেদিকে শুয়ে আছি সেদিকটাতে আছে তিনটে জানালাসেগুলো বন্ধ আছে। এদিকে আছে কয়েকটা বাক্সএকটা কাঠের তাক। তাতে রয়েছে কিছু কাগজপত্র। আমাদের মাথার দিকেও আছে দুটো জানালা সেগুলো বন্ধ। পায়ের দিকের জানালাগুলোর একটার দরজা অর্ধেকটা খোলা আছে। তারপরে সিঁড়ির কাছে আরেকটা জানালাও প্রায় বন্ধ। আমরা শোবার আগে রাজেশ্বর সিঁড়ির দরজাটা ভালো করে বন্ধ করে দিলেন। ভেতরের লাইটটা নিভিয়ে একটা কম পাওয়ারের বাল্ব জ্বালিয়ে দিয়ে রাজেশ্বর বলল“এবার শুয়ে পড়ুন। কাল সকালে আবার আমরা কাজ শুরু করবশুভ রাত্রি।”

আমরা শুয়ে পড়লাম। কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ে ছাতের দিকে তাকাতেই অবাক হয়ে গেলাম। নেই কোনো কড়ি-বরগানেই কোনো লোহার ছড়তবুও ছাত রয়েছে অটুট। কারণপাথরের লম্বা স্ল্যাব সুন্দর করে একের পর এক এমন ভাবে বসানো আছে যেবর্ষার জলও ঢুকতে পারবে না। সত্যিঅসাধারণ। প্রাচীন ভারতের ওই অজানা ইঞ্জিনিয়ারদের প্রতিভাকে একটা কুর্নিশ জানিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। সারাদিনের ক্লান্তির পরে শোবার সাথে সাথেই ঘুমিয়ে পড়লাম। কতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিলাম মনে নেই। হঠাৎ কি একটা শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল। চোখ খুলে সিঁড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি সেখানের দরজা খোলা। আমি তো চমকে গেলামকারণ আমার পাশে বাকী দু’জন ঘুমিয়ে রয়েছেন। আর শোবার আগে আমার সামনেই রাজেশ্বর সিঁড়ির দরজাটা ভালো করে বন্ধ করে দিয়েছিলেন। তাহলে ওটা খুলল কি করেআমি খুব তাড়াতাড়ি সিদ্ধান্ত নিলাম যেনিরাপত্তার কথা ভেবে আমাকে ওই দরজাটা বন্ধ করে দিতে হবে। কারণআমাদের সামনের ছোট্ট কাঠের আলমারিতেই রাখা আছে আজকের আবিস্কৃত সেই সোনার পাত ও অন্য জিনিসগুলোযার বাজারে দাম কয়েক কোটি টাকা। আমি বিছানা ছেড়ে উঠে শব্দ না করে সিঁড়ির দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে আবার শুয়ে পড়লাম। ও ঘুমিয়ে পড়লামকিন্তু আজ বোধহয় কপালে ঘুম নেই। আবার ঘুম ভেঙ্গে গেলএবার কম পাওয়ারের আলোতে যা দেখলাম তাতে তো আমার হৃৎস্পন্দন বেড়ে গেল। আমি দেখলাম সিঁড়ির দরজা আবার খুলে গেছে ও সেই খোলা দরজার সামনে একজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছেনওর দৃষ্টি আমার দিকে। আমি এবার সত্যি অবাক হয়ে গেলামকারণদরজাটা ভেতর থেকে ভালো করেই বন্ধ করা যায় ও প্রথমে রাজেশ্বর ও পরে আমি বন্ধ করে দিয়েছিলাম। তাহলে ওটা খুলল কি করেও এই লোকটি এখানে এল কি করে?

আমি ভালো করে দেখে নিলাম যেআলমারিটা ভালো করেই বন্ধ আছে। এবার লোকটি আমার দিকে তাকালআমার মনে হল ও হয়তো আমাকে কিছু বলতে চায়। আমি দেখলাম রাজেশ্বর ও যোগেশ অঘোরে ঘুমুচ্ছে। মনে হল ওদের জাগিয়ে কোনো লাভ নেই। তাই আমি আস্তে আস্তে বিছানা ছেড়ে উঠে সেই লোকটির দিকে এগিয়ে যেতেই ও আরেকবার সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল আর ওর পায়ের কোনো শব্দ শোনা গেল না। আমি সিঁড়ি দিয়ে নেমে কেল্লাটির বাইরে আসতেই সেই লোকটিকে ভালো করে দেখতে পেলাম। বাইরে এখন জ্যোৎস্নার আলোয় চারদিক আলোকিত হয়ে গিয়েছে। আকাশে পূর্ণ চন্দ্র হাসছেন ও সব কিছু দেখছেন। সেই লোকটি পরনে আছে সাদা সিল্কের ধুতিগায়ে একটি গাঢ় রংয়ের উত্তরীয়। ওর উচ্চতা পাঁচদশের মতোমাথার কালো চুল প্রায় ঘাড় পর্যন্ত নেমে এসেছে আর গলায়হাতে সোনার অলংকার রয়েছে। আমি লোকটিকে অনুসরণ করতে লাগলাম। আমি ওই দিকে যেতে লাগলামযে দিকে খননের কাজটি চলছে। আমাদের উল্টো দিকে প্রথমে আছে পাথরের তৈরি মন্ডপ যা প্রাচীন কালে নিরাপত্তারক্ষীদের জন্য নির্মিত হয়েছিল। ওগুলো পেরিয়ে আছে গেটযেখানে মোতায়েন আছে সশস্ত্র পুলিশ কর্মীরা। কিন্তু তারা আমাকে দেখতে পাবেনা। আমি বোধহয় একটু পেছিয়ে পড়েছিলামতাই সেই লোকটি একটু থেমে আমার দিকে পেছন ফিরে তাকাল। আমি এবার গতি বাড়িয়ে চলতে শুরু করলাম। আর ওর পেছনে যেতে আমার একটুও ভয় পাচ্ছিল না। মনে হল ও খুব ভালো মানুষ। যাইহোকআমি হাঁটছিলাম আর সামনের সেই প্রাচীন পাহাড় যেন সব কিছুর নীরব সাক্ষী হিসেবে দেখছিল। দিনের বেলায় এই জায়গাটা একদম অন্য রকম লাগছিল আর এখন এই রাত দেড়টার সময় পরিবেশ সম্পূর্ণ বদলে গেছে। চারদিক একদম নিস্তব্ধ। তাই একটু অন্যরকম লাগছে। আমরা এখন খননের স্থলে পৌঁছে গেছি। মাটি খোঁড়ার ফলে বিশাল খালের  সৃষ্টি হয়েছে ও দিনের বেলায় আমরা এখানে নেমে ছিলাম। আর এখন দেখলাম সেই লোকটি খালে নেমে গেল ও সোজা বাঁ দিকের সেই সুড়ঙ্গর দিকে এগিয়ে গেল। আমি ভয়ে ভয়ে খালে নেমে খোঁড়া নরম মাটির ওপরে দাঁড়ালাম। এবার লোকটি আমার দিকে আরেকবার তাকিয়ে সেই সুড়ঙ্গের ভেতরে ঢুকে পড়ল। সুড়ঙ্গটা পুরোটা খোঁড়া হয়নি। ওটা মাটি দিয়ে ভরাট করা আছে। মিঃ কুমার ওটা খুঁড়তে বারণ করেছিলেন। হয়তো আজ ওটা খুঁড়তে দেওয়া হবে। আমি এবার সামনের দিকে তাকিয়ে আর কিছু দেখতে পেলাম না। সেই লোকটি যেন কর্পূরের মতোই উবে গেছে। আমি প্রায় এক মিনিট মতো ওখানে দাঁড়ালামআর খুব দ্রুত পায়ে ওখান থেকে চলে এলাম। সিঁড়ি দিয়ে চড়তে চড়তে মনে হলআমি কি কোনো ভুল করলাম। দু’জন ঘুমন্ত লোককে ভেতরে রেখে বাইরে চলে গেলাম। কেউ যদি ভেতরে ঢুকে দামী জিনিসগুলো পালিয়ে যায়তার জন্য দায়ী হবে কেভেতরে ঢুকে দেখলাম ভয়ে ভয়ে মিঃ কুমার ও রাজেশ্বরের দিকে তাকিয়ে দেখলা ওরা ঘুমুচ্ছে। আর আলমারিটা তালা দেওয়াই আছে। আমি আস্তে আস্তে সিঁড়ির দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে নিজের বিছানায় শুয়ে পড়লাম

দোতলায় ঢুকেই আমার খুব ঠান্ডা লাগছিল আর বাইরে অত রাতেও আমার একটুও ঠান্ডা লাগেনি। ব্যপারটা আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না। কম্বল মুড়ি দিয়ে শোবার সাথে সাথেই আমি ঘুমিয়ে পড়লাম। আর ঘুম ভাঙ্গল সকাল ছটায়। দেখলাম রাজেশ্বর বিছানায় নেইবাথরুম থেকে বেরোলেন মিঃ কুমার। আমাকে দেখে “গুড মর্নিং” বললেন। শুধোলেন“রাতে ঘুম কেমন হয়েছে?

“গুড মর্নিং। ভালো। আপনার?

“আমারও ভালো ঘুম হয়েছে। এই প্রাচীন কেল্লায় যে এত ভালো ঘুম হবে তা ভাবিনি।” আমি বললাম

“অনুভূতিটা কেমন হল বলুন?

“এক কথায় অসাধারণ। এক ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা বললেও অত্যুক্তি হবে না।” আমি কাল রাতের সেই ঘটনার কথা বললাম না। বিছানা ছেড়ে উঠে বাথরুমে ঢুকে দাঁত মেজে আমি চেয়ারে বসে রাজেশ্বরের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। একটু পরে রাজেশ্বর এলেনসাথে একজন সেপাই ওঁর হাতে একটা পেল্লায় সাইজের ফ্লাস্ক আর সেপাইয়ের হাতে একটা থলিতে কাপডিশ আর বিস্কুটের প্যাকেট। রাজেশ্বর কাপে চা ঢেলে দিয়ে সামনের ছোট টেবিলে বিস্কুটের প্যাকেটটা রেখে দিয়ে বললেন“নিনএবার শুরু করুন।”

ওঁর মুখ থেকে জানতে পারলাম যেগেটের সামনে মোতায়েন সেপাইরা চা বানিয়েছে। একটু পরে জলখাবার আসবে। তার আগে আমরা খননের স্থলে গিয়ে আজকের পরিকল্পনার কথা ভাবব। আজ ভারতীয় প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগ থেকে কেন্দ্রীয় প্রতিনিধি দল আসবে

“তাই নাকিদিল্লি থেকে?

“হ্যাঁওরা কালই তিরুপতিতে এসেছেনআজ এখানে আসবেন। আর আমাকে রিপোর্টটা ওঁদের দেখাতে হবে। অবশ্য এখনও খোঁড়াখুঁড়ি শেষ হয়নি।” আমরা তিনজনে পাশাপাশি খাটে বসে বিস্কুট সহযোগে চা খেতে খেতে গত তিন দিনে খননের ফলে যা পাওয়া গেছে তা নিয়ে আলোচনা করছিলাম। রাজেশ্বর আমাদের আগেই চা শেষ করে আলমারি থেকে কালকে খননের ফলে খুঁজে পাওয়া সেই সিন্দুকটা বের করে তা থেকে স্বর্ণলিপিগুলো বের করে বলল“একি সেই তাম্রলিপিটা কোথায়ওটা তো এখানেই রাখা ছিলকাল তো এখানেই রেখেছিলাম।” ওকে খুব চিন্তিত দেখাচ্ছিল

আমরা চা শেষ করে রাজেশ্বরের কাছে গিয়ে সেই সিন্দুকটা থেকে সোনার পাতগুলো বের করে অবাক হয়ে গেলাম। সত্যিই তোএখানেই পাওয়া গেছিল সেই তাম্রলিপিটাআর কাল আমাদের চোখের সামনেই রাজেশ্বর ওগুলো এই সিন্দুকের ভেতরে রেখে ঢাকনাটা বন্ধ করে দিয়েছিলেনতাহলে ওটা গেল কোথায়অন্য কেউ জানতে পারলে আমাদেরই সন্দেহ করবে। কিন্তু আমরা তো জানি যেওটা আলমারিতেই রাখা হয়েছিল। রাজেশ্বর একজন বিখ্যাত লোকআর মিঃ কুমারও অত্যন্ত গুণী একজন মানুষএঁদের সন্দেহ করাও পাপ। তারপরে আমার কাল রাতের সেই ঘটনার কথা মনে পড়ে গেল। আচ্ছাসেই লোকটি কি আলমারি থেকে ওটা নিয়ে পালিয়েছেতাহলে সে আমাকে ডাকল কেনডেকে খননের স্থলেই বা নিয়ে গেল কেনও কি আমাকে কিছু বলতে চেয়েছিলকিন্তু এসব কথা আমি কাকে বলবআর কি করেই বা বলবকেউ কি বিশ্বাস করবেএইসব ভাবত ভাবতে গরম জলে চান সেরে নীচে চলে এলাম। রাজেশ্বরের সাথে খননের জায়গায় এসে একটা চেয়ারে বসে পড়লাম। একটু পরে খনন শুরু হল। মিঃ কুমার বললেন“কেন্দ্রীয় প্রতিনিধিদের সাথে কথা হয়ে গেছেওঁরা সুড়ঙ্গটা একটু খুঁড়ে দেখার অনুমতি দিয়েছেন। কিন্তু তার আগে আমাদের ওই তাম্রলিপিটা খুঁজে বার করতে হবে। কিন্তু কি ভাবেতা আমার মাথায় কিছুতেই আসছে না।” আমরা ওকে সান্তনা দিলামবললাম যেকিছু একটা উপায় বের করতে হবে

দু’জন শ্রমিক সুড়ঙ্গটার কাছে গিয়ে গাইতির আঘাত এনে মাটিগুলো সরাতে লাগল। তখন তৃতীয় শ্রমিকটি মাটিতে পড়ে থাকা একটা মাটির চাঙ্গড় তুলে একটা জিনিস হাতে নিয়ে আমাদের দিকে এগিয়ে এসে বলল“এটা কিকাল তো এটা ছিল না এখানে?

আমরা অবাক হয়ে দেখলাম ওর হাতে আছে কালকের হারিয়ে যাওয়া সেই তাম্রলিপিটা। ওটা রাজেশ্বর হাতে নিয়ে প্রায় কেঁদে ফেললেন। বললেন“এটা ভগবান বালাজীর আশীর্বাদ ছাড়া সম্ভব হত না। আমরা তো কোনো অপরাধ করিনি। তাই উনি চাননা যেআমরা কোনো বিপদে পড়িসেজন্যই এটা ফিরে পেলাম। আজ আমি এটা আপনাদের সবায়ের সামনে আলমারিতে রাখব।”

“পরে তো এটা এই কেল্লার সংগ্রহশালাতেই রাখা হবেতাই না? আমি প্রশ্ন করি

“হ্যাঁসেরকমই হবার কথা। তবে ভারতীয় প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগ যা ঠিক করবে তাই হবে।” বলে রাজেশ্বর ওটা ওঁর ব্যাগে ভরে ফেললেন। এরপরে আমরা কিছুক্ষণ সুড়ঙ্গপথ খোঁড়াখুঁড়ি দেখলাম। কাজটা খুব সহজ নয়কারণ ওখানের মাটি খুব শক্তপ্রায় পাথরের মতো। একটু পরে রাজেশ্বর বললেন“আপনারা গিয়ে জলখাবারটা খেয়ে আসুন। এখানে কারো থাকাটা দরকারআমি পরে গিয়ে খেয়ে আসব। একটা কথা মনে রাখবেনআজ আমাদের জলখাবার ও লাঞ্চ আসবে তিরুমালা মন্দির থেকে।”

শুনে তো আমি অবাক হয়ে গেলাম। তিরুপতির তিরুমালা পাহাড়ের বিখ্যাত ভেংকটেশ্বর মন্দিরের প্রসাদ শুধু মাত্র ভক্তরাই পেয়ে থাকেন। তাও অল্প পরিমাণেপাতার ঠোংগায় দেওয়া হয় একটু করে প্রসাদ। কারণহাজার হাজার ভক্তকে বেশী প্রসাদ দেওয়া সম্ভব নয়। আর আমরা পাব জলখাবার ও লাঞ্চ। বিশ্বাস হয় না। তাই আমি ওকে শুধোলাম“এটা কি করে সম্ভব হল?

“কারণআমরা ভিআইপিতাই।” বলে উনি হাসলেন

“আসলে আমরা মন্দির বোর্ডের কাছে বিশেষ অনুরোধ করেছিলামবলেছিলাম কেন্দ্রীয় প্রতিনিধিদল আসছেবাংলা থেকে একজন ঐতিহাসিক এসেছেন। তাই ওঁরা রাজী হয়ে গেলেন প্রসাদ পাঠাতে।” মিঃ কুমার বললেন। আমরা দু’জনে কেল্লার দিকে যেতেই একজন কনস্টেবল একটা কাপড়ের থলি হাতে দিয়ে বলল“এতে আপনাদের জন্য জলখাবার আছে।”

“আর আপনারা মিঃ কুমার প্রশ্ন করেন

“আমাদেরও আছে স্যর।” বলে সেই কনস্টেবলটা চলে গেল

“আসুন।” বলে সেই কাপড়ের থলিটা হাতে নিয়ে মিঃ কুমার আমাকে ডাকলেন। আমরা সোজা তাঁবুর ভেতরে ঢুকে বসে সেই থলি থেকে বের করা প্রসাদ খেতে শুরু করলাম। পোংগলদই ভাত ও লাড্ডু। খেয়ে মন ভরে গেল। এই প্রসাদের স্বাদই আলাদা। তাঁবুতে একটা ফ্লাস্কে রাখা ছিল গরম গরম চা। জলখাবারের পরে চা সেবন করে আমরা খননের স্থলে পৌঁছে রাজেশ্বরকে জলখাবার খেতে তাঁবুতে পাঠিয়ে দিলাম। রাজেশ্বর জলখাবার খেয়ে আসার একটু পরেই কেন্দ্রীয় প্রতিনিধিদল এসে গেল। আমরা ওঁদেরকে স্বাগত জানালাম। ওঁদের নাম মিঃ অংশুমান যোশীমিঃ ইকবাল হোসেন ও মিসেস নন্দিনী মন্ডল। মিসেস মন্ডলের নাম শুনেই বুঝতে পারলাম উনি বাঙালি। ওঁরা এসে খননের স্থলে গিয়ে সব দেখে খুবই খুশী হলেন। তারপরে আমাদের সাথে আলাপ আলোচনা শুরু করলেন। রাজেশ্বর ওঁদের সব কিছু খুলে বললেন ও কেল্লা থেকে সেই সিন্দুকটা এনে সব কিছু দেখালেন। দেখে ওঁরা খুব খুশী হলেন। ওঁরা বললেন যেসুড়ঙ্গটা বেশী দূর খোঁড়ার দরকার নেই। একটু দূর গিয়ে যদি দেখা যায় যেওটা অনেকদূর গেছে বা ওখানে কিছু পাওয়া যাচ্ছে নাতাহলে আর খোঁড়ার দরকার নেই। মিঃ যোশী যখন নিজের মোবাইলে কারো সাথে কথা বলছিলেন তখন আমি মিঃ হোসেন ও মিসেস মন্ডলের সাথে আলাপ করলাম। ওঁরা দু’জনেই বাংলার মানুষ। মিঃ হোসেন বর্ধমানের আর মিসেস মন্ডল হুগলী জেলার অধিবাসী। ওঁদের বিষয় হলগুপ্তযুগের সমাজ ব্যবস্থা ও চোলাদের উত্থান ও পতন। তবে মিসেস মন্ডল ‘আরলি চোলা’ বা খ্রিষ্টপূর্বাব্দের চোলাদের নিয়েও প্রচুর পড়াশোনা করেছেন

একজন কনস্টেবল একটা থলি নিয়ে আমাদের দিকে এগিয়ে এল। ও বলল যেলাঞ্চ এসে গেছে। ও থলিটা মিঃ কুমারের হাতে দিল। লাঞ্চের জন্য খোঁড়াখুঁড়ি এখন বন্ধ। আমরা সবাই তাঁবুতে বসে লাঞ্চ খেতে শুরু করলাম। লাঞ্চে আছে ভাতসাম্বারঝিংগের তরকারিকুমড়োর তরকারিদইতেঁতুল দেওয়া খিচুড়িশাক্কর পোঙ্গল বা মিষ্টি খিচুড়িহালুয়া ও পায়েস। খাবার অত্যন্ত সুস্বাদু। খেয়ে সবাই প্রশংসা করল। রাজেশ্বর নিজের রিপোর্টের প্রিন্ট আউট রেডি রেখে ছিলেন। উনি ওটা মিঃ যোশীর হাতে দিলেন। ওঁরা তিনজনেই তা পড়তে শুরু করলেন। পড়া হয়ে যাবার পরে আবার খননের স্থলে আমরা পৌঁছলাম। শ্রমিকেরা আবার খোঁড়াখুঁড়ি করল। অনেক কষ্টে ফুট দু’য়েক খোঁড়া পরে সুড়ঙ্গের দু’দিকে কারুকাজ করা স্তম্ভ দেখা গেল। এতে আমরা খুব উৎসাহিত হলাম। এবার সুড়ঙ্গের ডানদিকে একটা চৌকো গর্ত দেখা গেল। মাটি সরাতেই ওখানে দুটো হাঁড়ি পাওয়া গেল। ধাতুর তৈরি সেই হাড়িগুলোর ঢাকনা সরানোর পরে দেখা গেল ওতে আছে স্বর্ণ মূদ্রা। একটা মূদ্রা হাতে নিয়ে মিঃ যোশী বললেন“একিএতো সাতবাহন যুগের বলে মনে হচ্ছে?

“হ্যাঁ স্যর। তবে এরকম আগেও পাওয়া গেছেযেমন এই এখান থেকেই যে সিন্দুকটা পাওয়া গেল তাতে পল্লবদের চিহ্ন আঁকা আছেআর ওতে বিজয়নগরের লিপিগুলো রাখা ছিল। কিন্তু সাতবাহনযুগ তো অনেক আগেকারঅত পুরোনো সময়কার মূদ্রা এখানে রাখা ছিল। তার মানে এই সুড়ঙ্গটা দুই হাজার বছর আগের বলেই মনে হচ্ছে।” রাজেশ্বর বললেন    

“হতে পারেকিছুই অসম্ভব নয়। হয়তো যাদবরা এই কেল্লাটা বানাবার পরে এটা আবিষ্কার করেছিলেন ও নিজেদের ধনরত্ন ওখানে রাখতেন। পরে বিজয়নগরের শাসকরাও ওই জায়গাটা ব্যবহার করতেন।” মিঃ যোশী বললেন

“কিন্তু এই তাম্রলিপিটা অসম্পূর্ণ। এটার পরের অংশটা পেলে ভালো হত।” মিঃ হোসেন বললেন। আমরাও ওঁর সাথে একমত হলাম

“ওতে কি লেখা আছে তা আমরা জানতে চাই।” মিঃ যোশী বললেন

“ওতে লেখা আছে যে, ‘তুলুভা বীরানরসিংহ তাঁর গুপ্তচরদের পেনুনকোন্ডা ও চন্দ্রগিরির আশেপাশে মোতায়েন করেছে। উনি যে ক্ষমতা দখল করতে চান তা সহজেই বোঝা যায়। কিন্তু সালুভা বংশের সম্রাট দ্বিতীয় নরসিংহকে রক্ষার অনেক চেষ্টা আমি করছিদু’বার তাঁকে বাচিয়েছি ও আমাদের আরাধ্য দেবতার মূর্তি ছিনিয়ে নিতে দিই নি আশা করছি বীরানরসিংহ কিছুতেই ক্ষমতা দখল করতে পারবে না ও দ্বিতীয় নরসিংহর শাসনে সমগ্র দাক্ষিনাত্য উত্তর ভারতের সুলতানদের হাত থেকে চিরকালের জন্য রক্ষা পাবে। একদিন আমি এক গুপ্তচরকে ধরে ফেলি। ওঁর হাতে ছিল আমাদের কেল্লার নকশা.....’ এরপর এই তাম্রলিপিটা শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু দ্বিতীয় নরসিংহকে হত্যার ষড়যন্ত্র সবাই জানতে পারে। ওঁদের এক কাকাতো ভাই ব্যপারটা জানতে পেরেছিলতাই তাঁকে এখানে বন্দি করে রাখা হয়েছিলসাথে তাঁর কয়েকজন অনুগামী।” রাজেশ্বর বললেন

“কিন্তু দ্বিতীয় নরসিংহকে তো রক্ষা করা যায়নি। আসলে ১৫০৩ সালে ওঁর সেনাপতি তুলুভা নরসা নায়কর মৃত্যুর পরে তাঁকে রক্ষা করা আর কেউ ছিল নাতাই পেনুনকোন্ডায় এক রাত্রে উনি নিহত হন আর তারপরে ১৫০৫ সালে তুলুভা বীরা নরসিংহ রায়া ক্ষমতা দখল করেন ও নিজেকে বিজয়নগরের সম্রাট বলে ঘোষনা করেন। দ্বিতীয় নরসিংহ ১৫০৫ সালে খুন হন। নরস নায়কর পুত্র কৃষ্ণদেবারায়া ছিলেন এক শক্তিশালী সম্রাটযিনি পুরী পর্যন্ত দখল করেছিলেন ও পুরীর রাজাকে বন্দি করে এনেছিলেন। কিন্তু কে এই কাকাতো ভাইযাকে বন্দি রাখা হয়েছিলউনিই কি উপেন্দ্র রায়া? আমি প্রশ্ন করি

“আমারও তাই মনে হয়। তবে দ্বিতীয় নরস নায়কও কিন্তু সম্রাট ছিলেন। উনি দ্বিতীয় নরসিংহর সাথে প্রায় যুগ্মভাবে রাজত্ব করতেনযদিও নরসিংহকেই সম্রাট বলা হয়কিন্তু নরস নায়ককে তুলুভা বংশের প্রতিষ্ঠাতা বলা হয়। তাঁর মৃত্যুর পরে বীরানরসিংহরায়া সম্রাট হন। কিন্তু উপেন্দ্র রায়া কিভাবে দ্বিতীয় নরসিংহকে দু’বার গুপ্তঘাতকের হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন সেটা জানতে পারলে খুশী হতাম। আরাধ্য দেবতার মূর্তিটা পাওয়া গেলেও খুশী হব।” মিঃ কুমার বলেন

লাঞ্চের পরে একটু বিশ্রামের পালা। তারপরে আবার খোঁড়াখুঁড়ি শুরু হল ও সুড়ঙ্গর শক্ত মাটি একটু সরানো হল। কিন্তু কিছুই পাওয়া গেল না। সন্ধ্যে হয়ে যাবার পরে আমরা কেল্লায় ফিরে এলাম। বিকেলে চা খাওয়ার পরে মিঃ যোশীরা তিরুপতিতে ফিরে গেলেন। ওঁরা কাল সকালে আবার আসবেন। কালকের মতো আমরা আবার কেল্লার দোতলায় চলে গেলাম। দিনের বেলায় কেল্লার সংগ্রহশালা দেখতে অনেক পর্যটক এসেছিলতাঁরা অবশ্য খননের স্থলে আসেনি। আসলে তাঁরা কেউ জানতে পারেনি যেএই রকম একটা কাজ এখানে চলছে

রাতের খাওয়ার পরে আজও আমরা নিজেদের বিছানায় শুয়ে পড়লাম। তার আগে রাজেশ্বর আমাদের দু’জনকে দেখিয়ে সেই তাম্রপত্রটি আলমারিতে রেখে তালা বন্ধ করে চাবিটি বালিশের নীচে রেখে দিলেন  শুয়ে শুয়ে রাজেশ্বর বললেন“উপেন্দ্র রায়া বলেছেন যেউনি থাকতে দ্বিতীয় নরসিংহকে কেউ ক্ষমতা থেকে সরাতে পারবে না। তাহলে উনি কেন ওকে রক্ষা করতে পারলেন না

“সেটা তাম্রলিপির অন্য অংশটা পাওয়া গেলেই বোঝা যাবে বলে আমি মনে করি।” আমি বললাম

“আসলে নরস নায়কের অন্য সহযোগীরাও হয়তো চাইতেন যেসালুভা বংশের পতন হোক ও তুলুভা বংশ রাজত্ব শুরু করুক। তাই উপেন্দ্র রায়াকে এখানে বন্দি রাখা হয়েছিল। হয়তো ওকে নজর বন্দি রাখা হয়েছিলতাই উনি বুঝতে পারেন নি। ও দ্বিতীয় নরসিংহকে বার দু’য়েক রক্ষা করতে পেরেছিলেনকিন্তু তারপরে কি হল সেটা জানতে পারলে খুশী হতাম। তবে উপেন্দ্র রায়াকেই যে বন্দি রাখা হয়েছিল তাঁর কোনো প্রমাণ অবশ্য পাওয়া যায়নি। এটা আমার অনুমান।” মিঃ কুমার বললেন

কথা বলতে বলতে আমরা ঘুমিয়ে পড়লাম। রাত বাড়ার সাথে সাথে ঠান্ডা বাড়তে লাগলআমরা কম্বলটা ভালো করে গায়ে জড়িয়ে শুয়ে ছিলাম। কিন্তু আজও বোধ হয় আমার এক নাগাড়ে ঘুম হবার ছিল না। হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেল। চোখ খুলে দেখলাম কালকের সেই লোকটি আজ আবার এসেছেন। আর দাঁড়িয়ে আছেন সিঁড়ির খোলা দরজার সামনে। একবার আমার দিকে তাকিয়ে উনি সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেলেন। আমি আর এক মুহূর্ত দেরী না করে আড় চোখে ঘুমন্ত দু’জনকে দেখে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে বাইরে চলে এলাম। আর এসেই ওকে আবার দেখতে পেলাম। সেই লোকটি আমার দিকে একবার চেয়ে খননের দিকে হাঁটতে শুরু করল। এখন এই হাজার বছরের পুরোনো কেল্লার সামনে আমি আর একজন অচেনা রহস্যময় এক ব্যক্তি। কাল পূর্ণিমা ছিলতাই আজ ভালোই আলো আছেসেই আলোতে আমি একবার বাঁ দিকের নিরাপত্তারক্ষীদের ফাঁকা মন্ডপের দিকে তাকিয়ে সেই লোকটিকে অনুসরণ করতে শুরু করলাম। আর খননের স্থলে পৌঁছে দেখলাম ও নীচে নেমে দাঁড়িয়ে আছে। এখন খুব বেশী হলেও সেই লোকটি আর আমার মধ্যে বড় জোর আট ফুটের মতো দূরত্ব। আমি ওঁর চকচকে সিল্কের ধুতির সোনালি পাড় ও হলুদ উত্তরীয় খুব ভালো করে দেখতে পাচ্ছি। ওর গালের প্রায় দু’দিনের না কামানো দাড়ি গোঁফ আর হাতের সোনার বাজুবন্ধ ও গলার সোনার মালা দেখতে পাচ্ছি। লোকটির গায়ের রং উজ্জ্বল ও ওর বয়েস বড় জোর তিরিশের মতো মনে হচ্ছে। আর স্বাস্থ্যও খুব ভালো। এখন লোকটি একটু এগিয়ে সোজা সেই সুড়ঙ্গটার দিকে এগিয়ে গেল। সুড়ঙ্গটা একটু খোঁড়া হয়েছেআর সেই লোকটি সেই খোঁড়া সুড়ঙ্গের ভেতরে ঢুকে ওর ডানদিকের দেয়ালে হাত রেখে আমার দিকে তাকাল। ও সেই জায়গাটায় হাত রাখল যেখান থেকে আজ সকালে ওই হারানো তাম্রলিপিটা আবিষ্কৃত হয়েছিল। আমি যখন ভাবছি যেএরপর ও কি করবে বা ও কি বলতে চাইছেঠিক তখনই ও খোঁড়া সুড়ঙ্গের মধ্যে আরো একটু ঢুকে যেন অদৃশ্য হয়ে গেল। আমি খুব ভালো করে দেখেও ওকে আর খুঁজে পেলাম না। এক মিনিট সেখানে দাঁড়িয়ে আমি বুঝতে পারলাম যেওকে আর দেখতে পাব না। তাই আমি আলতো পায়ে কেল্লায় ফিরে এলাম। ও ভেতরে ঢুকে দেখলামমিঃ কুমাররাজেশ্বর দু’জনেই ঘুমুচ্ছে। আর আলমারিটা তালা দেওয়াই আছে। আমি সিঁড়ির দরজাটা ভালো করে বন্ধ করে দিয়ে শুয়ে পড়লাম। আর ঘুম ভাঙ্গল ঠিক সকাল ছটায়। আমি বিছানা থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে চেয়ারে বসে চায়ের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। একটু পরে রাজেশ্বর ও একজন নিরাপত্তারক্ষী চা নিয়ে এল ও আমরা তিনজনে তা পান করে নীচ যাবার জন্য তৈরি হলাম। রাজেশ্বর আলমারি খুলেই আজও চমকে গেলেন। উনি বললেন“এটা কি করে হলআজও সেই তাম্রলিপিটা নেইকিন্তু কি করে এটা হলমিঃ দত্তআমি তো কাল আপনাদের দেখিয়েই ওটা এখানে রেখেছিলাম। তাহলে ওটা গেল কোথায়?

আমরাও অবাক হয়ে গেলাম ও কাছে গিয়ে দেখলাম যেওই সিন্দুকের মধ্যে অন্য লিপিগুলো আছে কিন্তু সেই তাম্রলিপিটা অদৃশ্য। মিঃ কুমার ও আমি ওকে সান্তনা দিয়ে বলি“চিন্তা করার কোনো কারণ নেইওটা নিশ্চয় পাওয়া যাবেএখন নীচে যাওয়া যাক। আর আজ তো ওটা কেন্দ্রীয় প্রতিনিধিদের দেখাতে হবে না?

আমরা জামা কাপড় বদলে নীচে যেতেই খননের কাজে নিযুক্ত শ্রমিকেরা এসে পড়ল। একটু পরেই তিরুপতি থেকে কেন্দ্রীয় প্রতিনিধিরা এসে পড়লেন। ওঁরা এসে আজকের পরিকল্পনা সম্বন্ধে আলোচনা করতে লাগলেনআমরা ওঁদের সাথে কথা বলছিকিন্তু মনটা খুঁত খুঁত করছে কারণসেই তাম্রলিপিটা পাওয়া যাচ্ছে না। কথা থামিয়ে আমি সুড়ঙ্গের বাঁ দিকের সেই দেওয়ালের দিকে তাকালামরাতের বেলায় সেই লোকটি ওইখানে ওর হাতটা রেখে ছিল। আমার মনে হলওখানে নিশ্চয় কিছু রহস্য আছে। হঠাৎ ওই জায়গাটার ঠিক নীচে জড়ো করা মাটির মধ্যে তাম্রলিপিটার অংশটা দেখতে পেয়ে বললাম“ওই দেখুন। মনে হচ্ছে ওখানে কিছু আছে।”

আমার কথা শুনে রাজেশ্বর ওখানে গিয়ে মাটি গুলো সরিয়ে হারানো তাম্রলিপিটা দেখতে পেয়ে খুব খুশী হলেনআমরাও খুশী হলাম বরাত ভালো তখন কেন্দ্রীয় প্রতিনিধিরা পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলেন তাই দেখতে পাননি। রাজেশ্বর ওটা হাতে নিয়েই নিজের ঝোলায় ভরে ফেললেন আর আমাদের দিকে তাকিয়ে হাসলেন। ফিসফিস করে শুধোলেন“ব্যপারটা কি বলুন তোআমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। বার বার কেন এমন হচ্ছে আমাদের সাথে?

“মনে হচ্ছে ওটা লুকোচুরি খেলছে আমাদের সাথে।” বলে হাসলেন মিঃ কুমার। শ্রমিকেরা সুড়ঙ্গের মাটি সরাতে লাগলো। আমরা জলখাবার খেতে তাঁবুতে চলে গেলামশ্রমিকেরাও খেতে চলে গেল। আজ জলখাবার এসেছে তিরুপতির এক হোটেল থেকে। খেতে খেতে আমরা বিজয়নগর সাম্রাজ্যের উত্থ্বানের কথা ভাবছিলাম। ১৩৩৬ সালে সঙ্গম বংশের পত্তন করেন হরিহর ও বুক্কা। এঁরা আগে কর্ণাটকের হোয়শালা রাজাদের অধীনে কর্মচারী ছিলেন। দক্ষিণ ভারত প্রথমে মহম্মদ বিন তুঘলক ও আলাউদ্দিন খিলজির সৈন্যদের দ্বারা আক্রান্ত ও লুন্ঠিত হবার পরে এই দুই ভাই সঙ্গম বংশের মাধ্যমে বিজয়নগর সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন। পরে সালুভা বংশ ও শেষে তুলুভা বংশ এই সাম্রাজ্যের শাসক ছিল। ১৫৬৫ সালে তালিকোটার যুদ্ধে সুলতানদের কাছে এই বিশাল সাম্রাজ্যের পতন হয়সালুভা বংশের শেষ সম্রাট সদাশিব হেরে যানসুন্দর রাজধানী হাম্পি ধ্বংস করা হয়। কিভাবে বিজয়নগর যুদ্ধে হেরে যায় তা নিয়ে অনেক কাহিনি আছে। পরে তিরুমালা রায়া নামক এক ব্যক্তিযিনি বিজয়নগর সম্রাটদের এক আত্মীয় ও সেনাপতি ছিলেনআরুভিডু সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। যাদের রাজধানী ছিল অন্ধ্র প্রদেশের পেনুনকোন্ডা ও এই চন্দ্রগিরি। চন্দ্রগিরি প্রথমে প্রাদেশিক রাজধানী ছিল ও পরে প্রধান রাজধানীতে পরিণত হয়। সম্রাটরা তিরুপতিতে তীর্থ করতে এলে এই কেল্লাতেই থাকতেন

জলখাবার শেষ করে আমরা আবার খননের স্থলে গেলাম। শ্রমিকেরাও আহারান্তে কাজে যোগ দিয়েছে। তারা সুড়ঙ্গটা আবার খুঁড়তে শুরু করেছে। একটু পরেই তাঁরা একটা পাথরের স্তম্ভ দেখতে পেল। সেই স্তম্ভটা দেখতে পাবার পরে মনে হল যে ওটা একটু বেঁকে বাঁ দিকে চলে গেছে। এবার আমার রাত্রের  সেই ঘটনার কথা আবার মনে পড়ে গেল। আমি নীচে নেমে সুড়ঙ্গটার ডানদিকে সেই জায়গাটায় হাত রাখলামরাতে সেই লোকটা যেখানে হাত রেখেছিল। ওখানে হাত রাখতেই অন্য রকমের অনুভূতি হল। আমি একটা শাবল হাতে নিতে সেই জায়গাটায় দু’বার আঘাত করলাম। আঘাত করতেই মনে হল যেজায়গাটা ফাঁপা। আমি তখন একজন শ্রমিককে বললাম ওই জায়গাটা ভেঙ্গে ফেলতে। আমাকে ওখানে শাবল দিয়ে আঘাত করতে দেখে মিঃ যোশী ও অন্যান্যরা এগিয়ে এসেছেন। রাজেশ্বর আমাকে শুধোলেন“আপনি ওই জায়গাটা কেন খুঁড়তে বলছেন মিঃ দত্ত?

“আমার মনে হল ওখানে কিছু আছেকারণজায়গাটা ফাঁপা। আর ওই জায়গাটা বেশী দূর যায়নি। ওই দিকে তাকিয়ে দেখুনওটা বড়জোর আটফুট মতো গভীর। তারপর ওটা পাহাড়ের পাদদেশে মিশে গেছে। আমার মনে হয়পালিয়ে যাবার জন্য কেউ হয়তো ওটা বানিয়েছিল। কারণবাঁ দিকের সুড়ঙ্গ পথের চেয়ে এটা দিয়ে আরো তাড়াতাড়ি বেরিয়ে যাওয়া যায় আর যেহেতু রাস্তাটা পাথর দিয়ে আড়াল করা তাই গা ঢাকা দেওয়াটাও সহজ।” আমার কথা শুনে বাকীরা সম্মত হল ও দু’জন শ্রমিক ডানদিকের ওই জায়গাটা শাবল দিয়ে মারতে শুরু করল। আর খুব তাড়াতাড়ি মাটি সরে গিয়ে একটা সুড়ঙ্গপথ দেখা গেল। এর উচ্চতা পাঁচ ফুটের মতোঅর্থাৎ মাথা সোজা করে কেউ ওই পথ দিয়ে যেতে পারবে না। মাটি সরে যাবার পরে জায়গাটা প্রায় পরিষ্কার হয়ে গেল ও পাহাড়ের দিকের মাটিও সরাতে হল। তারপরে জায়গাটা এক্কেবারে সুন্দর দেখা গেল। আমরা একে একে ওই সুড়ঙ্গপথে ঢুকলাম। কিন্তু এখানেও চমক আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। সুড়ঙ্গের ঠিক ডানদিকে কতগুলো কুলুঙ্গি দেখতে পেলাম। ওগুলো কাঠের টুকরো দিয়ে এমন ভাবে ঢাকা দেওয়া ছিল যেভালো করে না দেখলে বোঝার উপায় নেই। আমরা কাঠগুলো সরিয়ে প্রথম কুলুঙ্গিটাতে পেলাম একটা সিন্দুকের মতো বাক্স। ওতে আছে একটা হীরেআর দামী পাথর খচিত সুন্দর মুকুটঅনেকগুলো সোনার মালা ও বাজুবন্ধ। এঁর মধ্যে একটা মালা গত দুদিন রাতের বেলা আমি দেখেছিলাম ওই লোকটির গলায়বাজুবন্ধটিও ওর হাতে বাঁধা ছিল পরেরটাতে পেলাম অনেকগুলো তলোয়ারতীর ধনুক ও ঢাল। তার হাতলে সংস্কৃত ও কান্নাড়া ভাষায় অনেক কিছু লেখা আছে। বিজয়নগরের সম্রাটরা কান্নাড়া ভাষাতেই বেশী কথা বলতেন। তৃতীয় কুলুঙ্গিটাতে আছে বংশীধর শ্রীকৃষ্ণের একটি সুন্দর মূর্তি। হাতে নিয়ে বুঝলাম ওটা খাঁটি সোনার। আর শেষ কুলুঙ্গিটাতে আছে একটি তাম্রলিপি। আমরা সুড়ঙ্গটা দিয়ে হেঁটে চন্দ্রগিরি পাহাড়ের পাদদেশে চলে এলাম। এখান থেকে প্রাচীন কেল্লা দুটি খুব সুন্দর দেখাচ্ছিল। আমরা আবার সুড়ঙ্গে ঢুকে সব জিনিসগুলো নিয়ে খননের কাছে রাখা চেয়ারে বসে পড়লাম। রাজেশ্বর শ্রমিকদের বললেন যেসুড়ঙ্গপথটা আবার মাটি দিয়ে বন্ধ করে দিতে। ওরা কাজ শুরু করে দিল। মিঃ যোশী বললেন“এগুলো দারুণ আবিষ্কার। আমরা খুবই খুশী হলাম। এই আবিষ্কারে সবাই খুব খুশী হবেন। এবার ওই লিপিতে কি লেখা আছে তা জানতে হবে।”

      তখন মিঃ কুমার ও রাজেশ্বর ওই প্রথম তাম্রলিপির লেখাটা আবার পড়তে শুরু করলেন। ওতে যা লেখা ছিলতা আবার এখানে দিলাম, ‘তুলুভা বীরানরসিংহ তার গুপ্তচরদের পেনুনকোন্ডা ও চন্দ্রগিরির আশেপাশে মোতায়েন করেছে। উনি যে ক্ষমতা দখল করতে চান তা সহজেই বোঝা যায়। কিন্তু সালুভা বংশের সম্রাট দ্বিতীয় নরসিংহকে রক্ষার অনেক চেষ্টা আমি করছিদু’বার তাঁকে বাচিয়েছি ও আমাদের আরাধ্য দেবতার মূর্তি ছিনিয়ে নিতে দিই নি আশা করছি বীরানরসিংহ কিছুতেই ক্ষমতা দখল করতে পারবে না ও দ্বিতীয় নরসিংহর শাসনে সমগ্র দাক্ষিনাত্য উত্তর ভারতের সুলতানদের হাত থেকে চিরকালের জন্য রক্ষা পাবে। একদিন আমি এক গুপ্তচরকে ধরে ফেলি। ওঁর হাতে ছিল আমাদের কেল্লার নকশা.....’ পড়া শেষ হয়ে গেলে মিঃ যোশী ওঁদের তাম্রলিপিটা অনুবাদ করে বলতে বললেন। তখন মিঃ কুমার বললেন“এতে উপেন্দ্র রায়ার সম্বন্ধে লেখা আছে। তার আগে আমি প্রথম তাম্রলিপিটা পড়ে শোনাচ্ছি।” বলে উনি সেটা পড়ে শোনালেন। তারপরেদ্বিতীয় তাম্রলিপিটা পড়তে শুরু করলেনএতে উনি বলেছেন,

“তাই আমি আর এখানে থাকতে পারলাম না। কারণপেনুনকোন্ডা থেকে আমার স্ত্রীপুত্র ও কন্যা এসেছেন। ওঁরা ভয় পেয়েই এসেছেন। আগে আমি একলা ছিলামআমার ওপরে আক্রমণ হলে আমি তা প্রতিহত করতে পারবকিন্তু এখন শত্রুরা ওঁদের ওপর আক্রমণ করলে আমি কি ওঁদের রক্ষা করতে পারবতাই আমার এখান থেকে পলায়ন করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। আমি ভাগ্যের হাতে সম্রাট দ্বিতীয় নরসিংহকে সঁপে দিয়ে এখান থেকে চলে যাচ্ছি। ঈশ্বর চাইলে ওর সাথে আবার দেখা হবে। আমি সঙ্গম বংশের উৎখাত সমর্থন করিনি আর সালুভা বংশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রও বরদাস্ত করতে পারব না। আমি এখান থেকে মাদুরাই চলে যাব। ও সেখানে আশ্রয় নেব। জয় ভেংকটেশ্বরজয় শ্রীকালাহস্তীশ্বর।” শ্রীকালাহস্তীশ্বর হলেন শ্রীকালাহস্তী মন্দিরের শিব ঠাকুর। পঞ্চভূতশিবের অন্যতম। এখানে উনি বায়ু লিঙ্গ রূপে প্রতিষ্ঠিত

“এটাই আছে এই দ্বিতীয় তাম্রলিপিতে। আর এঁর দ্বারা প্রমাণিত হয় যেশ্রীউপেন্দ্র রায়াই হলেন সম্রাট দ্বিতীয় নরসিংহর সেই কাকাতো ভাই। অর্থাৎ উনি হলেন সালুভা বংশের প্রথম সম্রাট সালুভা নরসিংহর ভাইপো। আর ওই শ্রীকৃষ্ণের মূর্তিটিই হল ওঁদের আরাধ্য দেবতাযা ওঁরা যেখানে যেতেন সাথে করে নিয়ে যেতেন।” রাজেশ্বর বললেন 

“এর দ্বারা এটাই প্রমাণিত হয় যেউপেন্দ্র রায়া বুঝতে পেরেছিলেন যেসম্রাট দ্বিতীয় নরসিংহকে সরানোর চেষ্টা চলছে। ও উনি ওকে রক্ষা করার অনেক চেষ্টা করেছিলেনকিন্তু শেষে যখন ওর স্ত্রীপুত্রকন্যা এখানে এল তখন ওঁদের কথা ভেবে উনি এখান থেকে পালালেন। আর সম্ভবত উনি ওই ছোট্ট সুড়ঙ্গপথেই এক রাতের অন্ধকারে পালিয়েছিলেন। ওর আদেশেই ওই তাম্রলিপি রচিত হয়েছিল। আর উনি যদি না চলে যেতেন তা হলে দ্বিতীয় নরসিংহকে কেউ সরাতে পারত না। কিন্তু সম্ভবত পেনুনকোন্ডাতে ওর স্ত্রীপুত্রকন্যার ওপরে নজরদারী হচ্ছিল তাই তাঁরা ভয় পেয়ে এই চন্দ্রগিরিতে চলে এসেছিলেন।” মিঃ কুমার বললেন

“খুব ভালো আবিষ্কার। এঁর দ্বারা আমরা এক অজানা ইতিহাসকে জানতে পারলাম। আমরা বুঝতে পারলাম যেউপেন্দ্র রায়া যদি নিজের কাজে কৃতকার্য হতেন তাহলে তুলুভা বংশ ক্ষমতায় আসতে পারত না আর তালিকোটার যুদ্ধে সুলতানরা কোনোদিন জিততেন না। মহান বিজয়নগর সাম্রাজ্যের পতনও হত না।” মিঃ যোশী বললেন। ওঁরা তিনজন বিকেল পর্যন্ত থেকে তিরুপতিতে চলে গেলেন। আগামীকাল ওঁরা দিল্লিতে ফিরে যাবেন। আর সেখানে ঠিক হবে এই আবিস্কৃত জিনিসগুলো কোথায় থাকবে। এখানে না রাজধানী বিজয়ওয়াডায় অথবা দিল্লিতে। ওই সুড়ঙ্গটা এখন আর খোঁড়া হবে না। তাঁবুতে বসে বসে আমরা কথা বলছি আর বিভিন্ন বাসে করে পর্যটকেরা আসছেন ও রাজামহলে ঢুকে ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলো দেখছেন 

আজ দুপুরের খাবার এসেছিল শ্রীকালাহস্তীর মন্দির থেকে। সত্যিআমরা খুব ভাগ্যবান। আমি ঠিক করলাম যেসন্ধ্যেবেলায় গত দু’দিনের রাতের কথা আমি সবাইকে বলব। সন্ধ্যেবেলায় চা খেতে খেতে আমি সব খুলে বললাম। শুনে রাজেশ্বর বললেন“তারমানে আপনি ওই উপেন্দ্ররায়াকেই দেখেছেন?

“কি জানি। হতেও পারে।” আমি বললাম

“হতেও পারে নয়। ওটাই ঠিক। উনিই এসেছিলেন আপনাকে ওই ছোট সুড়ঙ্গটার সন্ধান দিতেযাতে আমরা সবাই ওর কথা জানতে পারি। তাই না? মিঃ কুমার বললেন

“আপনি কিন্তু খুব ভাগ্যবান মিঃ দত্ত। এই কেল্লাতে আমরাও ছিলাম রাতের বেলায়কিন্তু উনি আপনাকেই দর্শন দিলেনআমরা কিছুই দেখতে পেলাম না।” রাজেশ্বর বললেন

শুনে আমি মুচকি হাসলাম। আজ রাতটাও আমরা এই কেল্লাতেই কাটালাম। নাআজ রাতে আর ঘুম ভাঙ্গল না। এল না সেই রহস্যময় সেই লোকটি। পরের দিন সকালে আমরা তিরুপতিতে চলে এলাম। সকালে তিরুমালা পাহাড়ে ঠাকুরকে দর্শন সেরে বিকেলে অন্য মন্দিরগুলো ঘুরে কাল আমি বাড়ি ফেরার ট্রেন ধরব। এই যাত্রায় আমি যা পেলাম তা আর কোনোদিন ভুলব না। এমন সুন্দর অথচ রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা কি ভোলা যায়?