বৈজ্ঞানিকের রান্নাঘর-১ । জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১





 কুসুমে কুসুমে 











অরূপ বন্দ্যোপাধ্যায়
দিল্লি, এন সি আর 



 

উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ হতেই রিয়ার মা তাকে কোলকাতা পাঠিয়ে দিলেন। সামনে প্রায় দুটো মাস কোনও পড়ার চাপ নেই। রেজাল্ট বেরবার দেরি আছে। রিয়ারা থাকে দিল্লি। কোলকাতায় পিসির বাড়ি হচ্ছে রিয়ার আপাতত দুই মাসের ঠিকানা। রিয়ার বাবা দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক, মা ব্যাঙ্কে কাজ করেন। কাজেই টানা দুই মাস রিয়াকে সঙ্গ দেবার কেউ নেই দিল্লিতে। রিয়ার বন্ধুবান্ধবের সংখ্যাও হাতে গোনা যায়। কারণ সে অন্যদের চাইতে একটু আলাদা। মোদ্দা কথা হল, রিয়া খুব মিশুকে নয়। আজকাল আবার কইয়ে বলিয়েদের বাজার। সে যাই হোক গে, আমরা চললাম রিয়ার সাথে কোলকাতা। হ্যাঁ, ট্রেনে নয়, প্লেনে।

প্লেনে উঠে রিয়া ঠিক করল সে পাইলট হবে নাএয়ারলাইনসের ক্রু-ও হবে নাসে অন্য কিছু হবে। কী হবেতা তার আগে থেকেই ঠিক করা আছেতাই মনে চাপ নেই কোনও। কেন এসব ভাবনা এল তার মনেএকা থাকলেই রিয়াকে রাজ্যের চিন্তা চেপে ধরে। চশমা লাগানো ছোট্ট মুখটা আরও গম্ভীর দেখায়। প্লেনের খাবারগুলো বিচ্ছিরি খেতেদামে আকাশ ছোঁয়কাজেই ক্রু-রা যখন খাবার বেচতে এলরিয়া মন দিয়ে প্লেনের জানলা দিয়ে আকাশে ভেসে চলা মেঘের দলের দিকে তাকিয়ে রইল

কোলকাতা বিমানবন্দরে তাকে নিতে এল পিসতুতো দাদা অর্ক। বহুদিন পিসিদের বাড়ির কারো সাথে দেখা হয়নি বলেই বেশ ক’বছর আগে দেখা অর্কদাকে চিনতে পারার কথাই ছিল নাযদি না মোবাইলে ফোন করে অর্ক না বলে দিত যে সে পিলার নাম্বার ১৮ র সামনে গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছে

অর্কদা একাই এসেছে। যদিও রবিবারকিন্তু রিয়ার ডাক্তার পিসির নার্সিং হোম তো আর সেদিন বন্ধ থাকে না! পিসেমশাই খুব ফুর্তিবাজ লোককিন্তু তিনি নাকি পাহাড়ে গিয়েছেন ট্রেকিং -এ। এসব খবর জানা ছিল। কিন্তু অর্কদা যে একটা দাড়িওয়ালা হোঁৎকামুখো লোক হয়ে গিয়েছেসেটা রিয়ার জানা ছিল না। গাড়ির ডিকিতে রিয়ার সুটকেস রাখতে রাখতে অর্ক বলল, “তুই তো একেবারে মামীর ডুপ্লিকেট হয়ে গিয়েছিস রে!”

তুমিও তো একেবারে আর সেই গলা ভাঙা অর্কদা নেই! এখন আদমি বনে গেছো!”

দিল্লিওয়ালি বাংলা বলছিস একেবারে! অবশ্য তোর আর দোষ কীকোলকাতাতেও ছেলেমেয়েরা একই ভাষায় কথা বলে। যাকবসে পড়।”

গাড়ি চলতে থাকে একডালিয়া রোড। রিয়ার পিসির বাড়ি। রিয়া আড়চোখে অর্ককে দেখে। কী একটা বিষয় নিয়ে যেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে রিসার্চ করে অর্ক। রিয়ার ঠিক জানা নেই। তার চাইতে অন্তত বছর সাতেকের বড়এইটুকু জানিয়েছিলেন রিয়ার মা

তাহলেপাস করে কী নিয়ে পড়বি ঠিক করেছিস?”

বিজ্ঞান…”ছোট্ট উত্তর আসে রিয়ার কাছ থেকে

বিজ্ঞানের অনেক শাখাকী সাবজেক্ট?”

সেটা তো ঠিক করিনি। তবে জয়েন্ট দিইনি। রেজাল্ট এলে বিষয় ঠিক করব।”

সেকি রেএখনো সাবজেক্ট ভেবে রাখিসনিপরে ভাববি মানেআরে জীবনে কী হতে চাস সেইটে ঠিক করেছিস কি না বল!”

রিয়া বেশ অপ্রস্তুত হয়ে যায়। বিজ্ঞান তার প্রিয় বিষয়। অর্কদা লেখাপড়ায় খুব ভালোরিয়া জানে। রিসার্চ শেষ না হতেই মাস্টারি করা শুরু। রিয়ার মুখ দিয়ে যে কী কুক্ষণে কথাটা বেরিয়ে যায়, “আমি বিজ্ঞানী হতে চাই।”

অন্য কেউ হলে হয়ত হেসেই কুটিপাটি হত। কিন্তু অর্ক তেমন কিছুই করল না দেখে রিয়া একটু ভরসা পেল

বাঃখুব ভালো কথা। তবে আমি বলি কীসাবজেক্টটা ঠিক করেই ফ্যাল এই ক’দিনে। দরকার হলে না হয় আমি তোকে সাহায্য করব। আগে দেখিতোর কোন দিকে বিজ্ঞানী হতে ইচ্ছে হচ্ছে। বিজ্ঞানী হয়ে করতেই বা কী চাস।”

অর্ক গম্ভীর মুখে গাড়ি চালাতে লাগলআর রিয়া একমনে কোলকাতার রাস্তাঘাট দেখতে লাগল। একসময়ে একডালিয়া রোডে পিসিদের পেল্লায় বাড়িটার সামনে এসে গাড়ি থামল। বহু আগে রিয়া বাবা-মায়ের সাথে বোধহয় দু’একবার এসেছেকিছুই মনে নেই

প্লেনে কিছুই খাওয়া না হওয়ায় রিয়ার পেটে ছুঁচো নাচানাচি করছে। একটু ফ্রেশ হয়েই খাবার টেবিলে ডাক পড়ল পিসির বাড়ির সহায়িকা জ্যোৎস্নাদির। রিয়া দেখলব্রেড টোস্টজ্যাম আর মাখনের সাথে একটা কাঁচের বাটিতে অনেকগুলো ডিম সেদ্ধ করে রাখা আছে। অর্কদা ল্যাপটপে কীসব লেখালেখি করছিল মন দিয়ে। সে বলল, “একাই খেয়ে নে। আমি ব্রেকফাস্ট করে এয়ারপোর্ট গিয়েছিলাম। খেয়ে ঘুমিয়ে পড়।”

ঘুম একটু পাচ্ছে ঠিকইকিন্তু রিয়ার ডিম সেদ্ধ দেখে গা গুলিয়ে উঠল। সে ব্যাজার মুখে পাউরুটি চেবাতে লাগল। দুটো পাউরুটি খেয়ে চেয়ার ঠেলে উঠতে যেতেই অর্কর ল্যাপটপ থেকে মুখ তুলে বলল, “ডিম সেদ্ধ খাস না?”

খাইতবে ইচ্ছে করছে না। হার্ড বয়েল হলে ভাল লাগে না।”

অর্ক মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করল, “কী করে বুঝলিযে ডিমগুলো হার্ড বয়েলশক্ত?”

বাড়িতে তেমনই তো খাই”

উঠে এসে অর্ক হাতে একটা ডিম তুলে নিয়ে রিয়ার হাতে দিয়ে বলল, “কী করে বুঝবি যে এটা হার্ড না সফট বয়েল”

না ভেঙে তো…”

না ভেঙে বোঝা যায় কী করে দেখাচ্ছি”বলেই ফ্রিজ থেকে একটা কাঁচা ডিম তুলে এনে টেবিলের উপর ঘুরিয়ে দিল অর্ক। তারপর সেদ্ধ ডিমটা ঘুরিয়ে দিল। রিয়া লক্ষ্য করলকাঁচা ডিমটা যেন কষ্ট করে ঘুরছেআর সেদ্ধ ডিমটা বাঁইবাঁই করে ঘুরে থেমে গেল

এই যে ছোট্ট খেলাটা দেখালামসেটা হাফ-বয়েল আর ফুল-বয়েল করে রাখা ডিম হলেও বোঝা যেত। কেন বল তোকাঁচা ডিমের ভিতরে যে তরল সাদা অংশ আর কুসুম থাকেতারা এই ডিমের ঘোরার উল্টো দিকে একটা ঘূর্ণায়মান বলের সৃষ্টি করেযার ফলে ডিমটা ঘুরতে চায় না জোরে। আধসেদ্ধ ডিম আর পুরো সেদ্ধ ডিম নিয়ে এই খেলাটা করে দেখতে পারিসবুঝে যাবি।”

রিয়া খুব উৎসাহ পেয়ে বলে, “জানো অর্কদাআমার আধসেদ্ধ ডিম খেতে ভালো লাগেকিন্তু বাড়িতে কেউ বানিয়ে দেয় না।”

বেশ করে। তুই নিজে করে নে। আমি বরং তোকে দেখিয়ে দেবকেমন করে খুব সহজে আধসেদ্ধ ডিম বানিয়ে নেওয়া যায়। আচ্ছাতুই না বললি তোর বিজ্ঞানী হবার ইচ্ছে! তাহলে রান্নাঘরকে আগে নিজের ল্যাবরেটরি বানিয়ে দেখ।”

রিয়ার মুখ দিয়ে ফস করে বেরিয়ে আসে, “ঠিক এই কথাটাই আমদের কেমিস্ট্রির স্যর বলেন ক্লাসে।”

আগে বিশ্রাম করে নে। কাল আমরা ডিমের বিজ্ঞান নিয়ে কথা বলব। আমাদের বাড়িতে সুবিধে হচ্ছে মা বাড়ি থাকে নাকাজেই পরীক্ষা করার জন্য রান্নাঘরে গেলে কেউ কিছু বলবে না। তবে এখানে জ্যোৎস্নাদি না থাকলেই সুবিধে। ভদ্রমহিলা এক নম্বরের গুপ্তচর মায়ের।”

আমাদের বাড়িতে রান্না করে প্রতিমাদি। সে অবশ্য আমারই দলে।”

তাহলে ওই কথাই রইলকাল থেকে আমাদের রান্নার পরীক্ষা নিরীক্ষা শুরু।”

          পরদিন অর্কদের বাড়ির সহায়িকা চলে যাবার পর শুরু হল রান্নার ক্লাস। অর্ক বলল, “চল আজ ডিম সেদ্ধ করি তোর মত করেমানে হাফ বয়েল। তার আগে বলডিমে কী থাকে?”

সাদা অংশটা হল এ্যালবুমেনআর ভিতরে থাকে কুসুমমানে ইয়োক। এ্যালবুমেনে থাকে কার্বোহাইড্রেট। কুসুম বা এগ-ইয়োকে থাকে প্রোটিন আর কোলেস্টেরল।”

ডিমের বাইরের খোলাটা বাদ দিলি কেনসেটা কিন্তু ক্যালসিয়ামের একটা যৌগ দিয়ে তৈরি। এটা খুব একটা তাপ পরিবাহী নয়। ডিমের বেশিরভাগ প্রোটিন কিন্তু কুসুমে থাকে। এটা হচ্ছে ফ্যাট আর জলের একটা ইমালশান। ফ্যাট জলে মেশে নাসেটা তো নিশ্চয়ই জানা আছে। ডিমের মোট ওজনের এক তৃতীয়াংশ থাকে কুসুমেযাতে ৫০ শতাংশ জল৩২ শতাংশ ফ্যাট আর ১৭ শতাংশ প্রোটিন আছে। তাই কুসুম ফেলে দিয়ে ডিমের সাদা অংশ খেয়ে শরীরের ফ্যাট কমানোর চেষ্টা খুব একটা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। আজ পর্যন্ত জানা যায়নি সঠিকভাবেআদৌ কুসুম খেলে কোলেস্টেরল বাড়ে কিনা। কবিগুরু কী সাধে বলে গেছেন- কুসুমে কুসুমে চরণচিহ্ন রেখে যাও!”

কুসুমের রঙ খাতার পাতায় কীভাবে আঁকতিস ছোটবেলায়অনেকটা ঠিক অস্তগামী সূর্যের মতোতাই নাকিন্তু বাজারে যে ডিম আনা হয়তার রঙ কী টকটকে লালবা কমলা রঙের হয়হয় না। এর পিছনেও আছে বিজ্ঞান। আজকাল যে সব ডিম বাজারে কম দামে পাওয়া যায়সেই মুরগীগুলোকে খেতে দেওয়া হয় গমকাজেই প্রোটিনেও সেই রঙ ধরে। কিন্তু যেসব মুরগী চড়ে বেড়ায় ক্ষেতে খামারেতার কিন্তু ব্যালেন্সড ডায়েট খায়। কারণ তারা যেমন খুঁটে খুঁটে ছোট ছোট ফলশস্যদানাঘাসের বীজ খেয়ে বেড়ায়তার সাথে ওড়া কিন্তু ছোট ছোট পোকামাকড়ও খেয়ে ফেলে। কাজেই বুঝতে পারছিসওদের শরীরে প্রোটিন একেবারে পুষ্টিকর। কাজেই সেই ডিমগুলো খেতে হয় সুস্বাদু।”

অরগানিক ডিম বলে বাজারে যে ডিমগুলো বিক্রি হয় তাদের দাম বেশি হয় কেন?”

কারণ পোলট্রি ফারমের মালিকেরা মুরগী গুলোকে প্রোটিন রিচ খাবার খেতে দেয়দামটা তো আমাদের কাছ থেকেই তুলে নেবেতাই না?”

এবার সাদা অংশ নিয়ে কিছু বল”উৎসাহ পেয়ে রিয়া জিজ্ঞেস করে

হ্যাঁসেইটা বলি। ডিমের বাইরে যে এলবুমেন আছেযাকে সাদা অংশ বলে সেদ্ধ করার পরসেটিতে আছে মোট ওজনের ৯০ শতাংশ জল এবং ১০ শতাংশ প্রোটিন আছে। এখানে ফ্যাট অবশ্যই নেইকিন্তু সামান্য মাত্রায় কিছু মিনারেল এবং কার্বোহাইড্রেট আছে

কুসুম শক্ত হয়ে গেলে ডিম খাবার মজার বারোটা বাজে। কিন্তু এই বারোটা বাজানোর পিছনে আছে অতিরিক্ত তাপ। যখন গরম জলে ফেলে ডিম সেদ্ধ করা হয়তখন ডিমের প্রোটিন ভাঙতে শুরু করে। কাঁচা ডিমে প্রোটিনের শৃঙ্খল অটুট থাকেযেই উত্তাপ দেওয়া শুরু হয়েতখন প্রোটিনের হাইড্রোজেন-বন্ড ভাঙতে থাকেকাজেই জট পাকিয়ে প্রোটিন জমাট বাঁধে। ৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কাছাকাছি ডিমের কুসুম নরম থাকে। এর বেশি তাপমাত্রা হলেই শক্ত হয়ে যায়

ডিমসেদ্ধ উপাদেয় রাখতে হলে সবচাইতে ভালো হচ্ছে গরম জল ফুটে গেলে আঁচ কমিয়ে পাঁচ মিনিট সেদ্ধ করোতারপর ঠাণ্ডা জলের ভিতরে ডিম ফেলে দিয়ে কিছুক্ষণ পর তুলে নাও। ছাড়াতে একটু কষ্ট হলেও সুস্বাদু কুসুম অবশ্যই রসনা পরিতৃপ্ত করবে

যে কোনও রান্না হচ্ছে একটি রাসায়নিক বিক্রিয়া আর তাপ নিয়ন্ত্রণ না করতে পারলে বিক্রিয়া অর্থাৎ রান্নার বারোটা থেকে তেরোটাও বেজে যেতে পারে।”

কথা বলতে বলতেই এই কায়দায় ডিম সেদ্ধ করে দেখিয়ে দিয়ে রিয়াকে ডিমগুলো ছাড়িয়ে ফেলতে বলে অর্ক। রিয়া প্রশ্ন করে, “জল ফুটে যায় ১০০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। তাহলে কুসুম পর্যন্ত নিশ্চয়ই তখুনি ১০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস উত্তাপ হয় না। ডিমের কম পরিবাহী খোলাই এর জন্য দায়ীঠিক বললাম তো?”

একদম ঠিক। এবার চল চুপচাপ সব রান্নাঘরে আমাদের কাণ্ডকারখানার সাক্ষ্যপ্রমাণ মিটিয়ে দিই দুজনে। আজকের মত আমাদের ক্লাস শেষ। কাল আবার নতুন কিছু পরীক্ষা করে দেখা যাবে। বিজ্ঞানী না হতে পারলেও খাদ্যের চাইতে বড় বিজ্ঞান নেইএটা অন্তত মনে রাখতে পারবি।”