তোমরা যারা আজ পর্যন্ত ঘোড়মুহাদের নাম
শোনোনি, তাদের আগেভাগেই জানিয়ে রাখছি – ঘোড়মুহা নামে প্রাণীদের মাথা অবিকল ঘোড়ার
মতো, আর হাত দুটি এক্কেবারেই মানুষের মতো। তবে পায়ের আদলটা বেশ খানিকটা মানুষের
মতো হলেও, তাদের কেবলমাত্র একখানা করেই পা থাকে! সেই সাথে এও বলে রাখা ভালো, তাদের
সম্পর্কে কিন্তু একটি হাড়-হিম-করা কথা বাতাসে ভেসে বেড়ায় – ঘোড়মুহারা নাকি নিখাদ
নরখাদক! মানুষের মাংস ছাড়া তাদের মুখে নাকি কিছুই রোচে না! এখন প্রশ্ন হল, এই
ঘোড়মুহাদের কথা মানুষেরা জানতে পারল কী করে? – এই প্রশ্নের উত্তরটাই লুকিয়ে রয়েছে
এই গল্পটিতে।
লাল মাটির দেশের এক নাম-না-জানা গ্রামে
সোমাই নামে একজন সাহসী যুবক বাস করত। সেই গ্রামের শেষ প্রান্তে ছিল একটি ঘন সবুজ
বন। একদিন সোমাই তীর ধনুক নিয়ে সেই বনে গেল হরিণ শিকার করতে। একটি হরিণের পিছু ধাওয়া করতে-করতে একসময় সে ঢুকে পড়ল
বনের অনেক গভীরে। কিন্তু হরিণ তো ভীষণ চঞ্চল।
সবসময় তিড়িংবিড়িং করছে। সে ছুটতেও পারে খুব দ্রুত। তাকে কি আর এত সহজে বাগে আনা
সম্ভব? তবে সোমাইও খুব জেদি ছেলে, এত সহজে হাল ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নয় মোটেই। তাই বনবাদাড়-খানাখন্দ পেরিয়ে হরিণের পেছনে ধনুক
উঁচুয়ে আপ্রাণ ছুটতে লাগল সে। অন্তত একটা হরিণ শিকার করে তবেই সে গ্রামের পথ ধরবে
- এমনই কঠিন পণ ছিল তার!
হরিণের পেছনে দৌড়তে দৌড়তে একসময় বন ফাঁকা
হয়ে এল, আর ঠিক তক্ষুনি হরিণটি লাফাতে-লাফাতে ঢুকে পড়ল এক অজানা দেশে! সে-দেশে
আবার মানুষের ঢোকা মানা। সোমাই অবশ্য সে-সব কথা মোটেই জানে না। আর
জানবেটাই বা কীভাবে? এই দেশের কথা তো কেউ-ই জানে না। এর আগে কোনো মানুষই তো শোনেনি
এ-দেশের গল্প! তাই না জেনে বুঝে হরিণের পিছু পিছু সোমাই ঢুকে পড়ল সেই অজানা বিপদের
দেশে!
অবশ্য বেশি দূর এগোনো গেল না। অল্প
কিছুটা পথ যেতেই আচমকা সোমাইকে ঘিরে ধরল এক দল আজব এক-পেয়ে ঘোড়ামুখো প্রাণী। তাদের
এমন ভয়ানক চেহারা দেখে সোমাইয়ের মতো সাহসী ছেলেরও পিলে চমকে যাওয়ার যোগাড়! মনে মনে
সোমাই তাদের নাম দিল ঘোড়মুহা। এর পর যা যা হওয়ার ছিল ঠিক তাই তাই হল। ঘোড়মুহারা
সোমাইকে ধরে বেঁধে তাদের বাড়িতে নিয়ে গেল - রসিয়ে কসিয়ে কব্জি ডুবিয়ে চেটেপুটে
খাওয়ার জন্যে।
স্বাভাবিকভাবেই সোমাইকে পেয়ে ঘোড়মুহাদের
মনে আনন্দের বন্যা বইতে লাগল। তবে ঘোড়মুহারা মনে করে, রান্না খুবই উন্নতমানের একটি
শিল্প। তাই শিকারকে ধরে এনে তৎক্ষণাৎ খেয়ে ফেলবার জো নেই। শিকারকে সুস্বাদু
খাদ্যে রূপান্তরিত করতে
বেশ কিছু দিন ধৈর্য্য
ধরে অপেক্ষা করতে
হয় তাদের। অনেক সময় নিয়ে নানান প্রক্রিয়ার মাধ্যমে
শিকারকে ক্রমশ মনের মতো খাদ্যে পরিণত করা হয়। সোমাইয়ের ক্ষেত্রেও এই নিয়মের
ব্যতিক্রম ঘটায়নি ঘোড়মুহারা। তাকেও সুখাদ্যে
রূপান্তরিত করা হবে। কিছু দিন নাহয় ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষাই করবে তারা। তাই প্রথমেই সোমাইয়ের শরীর ও জামাকাপড় থেকে পোকামাকড়
তাড়াতে দু-তিন দিন ধরে ক্রমাগত ধোঁয়া দেওয়া হল সোমাইয়ের শরীরে, যাতে সব ক্ষতিকারক
পোকামাকড় তার শরীর ও জামাকাপড় থেকে পালিয়ে যায়। দ্বিতীয় পর্যায়ে শুরু হল সোমাইকে
মোটা করবার প্রক্রিয়া। প্রতিদিন সোমাইকে প্রচুর পরিমাণে হলুদ মাখা ভাত খাওয়াতে
লাগল ঘোড়মুহারা। অল্প কয়েকদিনেই সোমাই বেশ অনেকখানি মোটা
হয়ে গেল!
এদিকে সোমাই ছাড়া আরও বেশ কয়েকজন মানুষকে
ঘোড়মুহারা খাবে বলে বন্দি করে রেখেছিল। সোমাই অসহায় চোখে দেখত, হাত-পা বাঁধা
জ্যান্ত মানুষকে একটি টগবগে ফুটন্ত তেলের কড়াইয়ের মধ্যে ছুঁড়ে ফেলে দিত ঘোড়মুহারা। তার পর তেল-মশলায় ভাজা দেহটিকে দরজার ওপর টাঙ্গিয়ে
দেওয়া হত। এতে কিন্তু ঘোড়মুহাদের খুব সুবিধে হত - ঘরে ঢোকা বা বেরোনোর পথে চটপট
একখানা কামড় বসানো যেত। খাওয়ার জন্য আলাদা করে সময় নষ্ট করতে হত না তাদের।
ঘোড়মুহাদের এসব নরকীয় কীর্তিকলাপ দেখে সোমাইয়ের চোখ দিয়ে টপটপ করে জল পড়ত, কখনও
আবার আতঙ্কে গা শিরশির করত। অচিরেই নিজেরও এমন গতি হবে কল্পনা করে
বারে বারে শিউরে উঠত সে।
তবে এখানেই সব শেষ নয়। কিছুদিন বাদে
সোমাইয়ের সাথে শুরু হল আরেক রকমের অদ্ভুত ব্যবহার।
এক-পেয়ে জীব হলে কী হবে, ঘোড়মুহারা ভীষণ
দ্রুত গতিতে ছুটতে পারে। তাই প্রতিদিন সোমাইকে তাদের সাথে দৌড়
প্রতিযোগিতায় নামতে বাধ্য করত তারা।
এমনটা যে ওরা এমনি এমনি খেলাচ্ছলে করত তা কিন্তু নয়। ঘোড়মুহাদের আসল উদ্দেশ্য ছিল
সোমাইয়ের শারীরিক শক্তি পরীক্ষা করা। সোমাই যে-দিন তাদের দৌড় প্রতিযোগিতায় হারিয়ে
দেবে সে-দিনই তারা বুঝে যাবে, সোমাই যথেষ্ট শক্তিশালী হয়ে গিয়েছে, মানে সোমাইকে
খাওয়ার সঠিক সময় এসে গিয়েছে। তাই প্রতিদিন দৌড়
প্রতিযোগিতা চলতে লাগল। এক সময় দেখা গেল, সোমাই দৌড়
প্রতিযোগিতায় অনায়াসে হারিয়ে দিতে পারছে ঘোড়মুহাদের। দৌড়
প্রতিযোগিতায় হেরে গিয়ে ঘোড়মুহাদের সে কী আনন্দ! এবার তারা ঘোষণা করল, পরবর্তী দৌড়
প্রতিযোগিতা হবে দেশের সবচাইতে বড় মাঠে।
এদিকে ঘোড়মুহাদের আসল ফন্দিটা ধরে
ফেলেছিল সোমাই। তার কাছে ক্রমশ ব্যাপারটা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে, ঘোরমুহারা তার
স্বাস্থ্য পরীক্ষা করছে। আগামী দৌড় প্রতিযোগিতায় ঘোড়মুহাদের হারিয়ে দিলেই তাকে
সোজা যেতে হবে ঘোড়মুহাদের পেটে। এই অবস্থায় তার সামনে একটাই পথ খোলা আছে- যত
ঝুঁকিই থাক না কেন, এই দেশ ছেড়ে পালাতেই হবে। এখানে থাকলে তাকে ঘোড়মুহাদের খাদ্য
হতে হবে, আবার পালাবার পথে ধরা পরলেও তার একই গতি হবে। তাই একবার পালাবার চেষ্টা
করে দেখতেই বা আপত্তি কী? অনেক সাতপাঁচ ভেবে সে সিদ্ধান্ত নিল, এই বিপদজনক দেশ
থেকে পালাবার ঝুঁকি নিতেই হবে তাকে।
পরের দিন সকালে ঠিক সময় মতো বড় মাঠে শুরু
হল দৌড় প্রতিযোগিতা। সেদিনকার প্রতিযোগিতায় সোমাই প্রায় জিতেই যাচ্ছিল, কিন্তু
নিজের গতি কমিয়ে ঘোড়মুহাদের কাছে ইচ্ছে করে হেরে গেল সে। তবে পরের দিন দৌড় প্রতিযোগিতার সময় সে নিশ্চিতভাবে
পালাবার চেষ্টা করবে বলে মনস্থির করে নিল। এদিকে
ঘোড়মুহারাও অন্যরকম কিছু একটা আঁচ করে নিয়ে, পরের দিন সোমাইকে খাবে বলে চুপচাপ
সিদ্ধান্ত নিল, তা সেই প্রতিযোগিতার ফল যা-ই হোক না কেন।
দ্বিতীয় দিন দৌড় প্রতিযোগিতা শুরু হতেই
সোমাই দৌড়তে দৌড়তে হঠাৎ করে দিক পরিবর্তন করে পাশের নিচু জমির ঢাল বেয়ে প্রাণপণ
ছুটতে লাগল। কিছু দূর যেতেই শুরু হল এবড়োখেবড়ো
উঁচুনিচু জমি। সোমাই অনায়াসে সেই উঁচুনিচু জায়গা লাফিয়ে পেরিয়ে যেতে লাগল। কিন্তু এক-পেয়ে ঘোড়মুহারা দ্রুত বেগে ছুটতে পারলেও,
একেবারেই লাফাতে পারে না। তাই যে সব ঘোড়মুহারা সোমাইকে ধরবার জন্য
তার পিছু ধাওয়া করেছিল তারা লাফাতে গিয়ে ডিগবাজি খেয়ে মাটিতে পড়ে গড়াগড়ি খেতে
লাগল। ঘাড় ঘুড়িয়ে তাদের সেই সব কাণ্ডকারখানা দেখে সোমাই তো এই বিপদের মধ্যেও হেসে
কুটিপাটি। কিন্তু তখন কি আর শান্তিতে একটু হাসবার সময় আছে? তাই একটুও সময় নষ্ট না
করে সোমাই সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করল। একবারও পিছন ফিরে না তাকিয়ে
ঝোপঝাড়-খানাখন্দ-বনবাদাড় পেরিয়ে দিল দৌড়। সেই দৌড় শেষ হল তার গ্রামে এসে। এভাবেই
অবশেষে সোমাই বেঁচে ফিরে এল তার আপন দেশে - তার নিজের বাড়িতে।
আসলে সোমাই হল সেই প্রথম মানুষ যে কিনা
মানবজাতিকে ঘোড়মুহাদের খোঁজ দিয়েছিল। শুনিয়েছিল ঘোড়মুহাদের বিচিত্র চেহারার কথা,
জানিয়েছিল কেমন ভয়াবহ তাদের জীবনযাত্রা। তার আগে কেউ কল্পনাও করতে পারেনি এমন
নরখাদক এক-পেয়ে ঘোড়ামুখো জীবেরা পৃথিবীর বুকে হেঁটে-চলে বেড়াতে পারে! তোমরাও কি
কস্মিনকালে এমন ভয়ঙ্কর প্রাণীদের কথা ভাবতে পেরেছিলে?