বিশেষ - চার মানুষের শহর - কমলবিকাশ বন্দ্যোপাধ্যায় । জানুয়ারি - ২০২৪

    




  চার মানুষের শহর









ক ম ল বি কা শ 
বন্দ্যোপাধ্যায় 






....

....

কিশোর বার্তা-র 
এই গল্পটির ছাপা সংখ্যাটি রেজিঃ ডাকে পেতে -

 

 

গাড়ি যত এগোচ্ছে দূরের পাহাড়টা তত বড় হচ্ছে। দেখতে দেখতে পাহাড়ের পাদদেশে ভেসে উঠল একটা শহর। আর কিছুক্ষণ পরেই পৌঁছে যাব পৃথিবীর সবচেয়ে ছোট শহরে। এক সময়ে এই শহরে হাজার-দুয়েক লোকের বাস ছিল। এখন শহরের বাসিন্দা মাত্র চারজন। অবাক করা এই শহরটি কানাডার নিউফাউন্ডল্যান্ড ল্যাব্রাডরে অবস্থিতনাম টিল্ট কোভ। এটি কানাডার সবচেয়ে ছোট শহর তো বটেইহয়তো পৃথিবীরও সবচেয়ে ছোট্ট শহর। একটি লেককে ঘিরে মনোরম পরিবেশে গড়ে উঠেছে শহরটি। 

        যুক্তরাজ্যের জর্জ এবং মেরি উইনসন নামের এক দম্পতি ১৮১৩ সালে এই শহরটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। প্রথমদিকে কারও তেমন আগ্রহ ছিল না এই প্রত্যন্ত অঞ্চলে এসে বসবাস করার। বেশ কিছুদিন পর থেকে একজন-দু’জন করে লোক আসতে শুরু করে। ১৮৫৭ সালে অর্থাৎদীর্ঘ ৪৪ বছরে শহরের লোকসংখ্যা দাঁড়ায় মাত্র ২৫ জনে। এর পরেই ঘটল এক অভাবনীয় ঘটনা। ১৮৮৪ সালে শহরের অনতিদূরে পাহাড়ের কোলে আবিষ্কৃত হল সোনা-তামাসহ নানা ধরনের খনি। খবর রটে যেতেই খনি ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ব্যবসায়ী ও শ্রমিকের মিছিল এগিয়ে আসতে লাগল ছোট্ট শহরটির দিকে। দেখতে দেখতে ছোট্ট শহরটি মানুষে ভরে গেলজনসংখ্যা দাঁড়াল দু-হাজারের মতো

        ভালোই চলছিল, শহর ধীরে ধীরে সেজে উঠছিল। কিন্তু হঠাৎ-ই সব ওলট-পালট হয়ে গেল। ১৯৬৭ সালে প্রধান খনিটিতে ঘটল এক ভয়ংকর দুর্ঘটনা। তড়িঘড়ি খনি বন্ধ করে দিতে হল। কাজ হারাল বহু শ্রমিক। নতুন কাজের খোঁজে তারা অনত্র চলে যায়। কানাডার এক পরিসংখ্যানে জানা যায়, ২০১১ সালে শহরের লোকসংখ্যা দাঁড়ায় মাত্র ৫ জন। ২০১৭ সালে সেই সংখ্যা কমে হয় ৪ জন। এরা শহরের মায়া ত্যাগ করে অন্যত্র চলে যেতে পারেনি

        যতই কম হোক, শহরে যখন মানুষের বাস রয়েছে তখন নাগরিক পরিষেবা তো চালু রাখতেই হবে। আর তার জন্য একজন মেয়র থাকা দরকার। পৃথিবীর সবচেয়ে ছোট এই শহরটিতে একজন মেয়র আছেন, আর তিনি হলেন ওই চারজনের একজন। চারজন বাসিন্দারই বয়স পঞ্চাশের ঊর্ধ্বে। আত্মীয়তার সূত্রে এরা একই পরিবারের সদস্য। মেয়রের বোন এবং শ্যালক কাউন্সিলরের পদে আছেন। ক্লার্কের পদে যিনি আছেন তার জন্ম এই শহরেই- নাম মার্গারেট কলিন্স। এই চারজন ছাড়া টিল্ট কোভ শহরে আর কেউই থাকে না। চারজনই এই শহরটিকে এতটাই ভালোবাসেন যে এখান থেকে চলে যাওয়ার কথা তারা স্বপ্নেও ভাবতে পারেন না। শুধু তাই নয়, শহরে ডাক ব্যবস্থা থেকে শুরু করে অন্যান্য সকল নাগরিক সেবা ব্যবস্থা চালু আছে। কলিন্স দম্পতি যে বাড়িতে থাকেন অপর পরিবারটি অর্থাৎ, ডনের বোন ও মার্গারেটের ভাই পাশের আরেকটা বাড়িতে থাকেন

        চারজন বাসিন্দা ছাড়া শহরে আর কোনো লোক নেই, তাই কাজের চাপও তেমন নেই। তবে নিজস্ব ডাক পরিষেবার ব্যবস্থা থাকায় চিঠি সরবরাহ থেকে শুরু করে রাস্তাঘাট রক্ষণাবেক্ষণ, আবর্জনা পরিষ্কার, পানীয় জলের পরিষেবা এমনকী রাতের শহরকে আলোকিত করে রাখতে যে গোটা দুই স্ট্রিট লাইট রয়েছে তার রক্ষণাবেক্ষণের মতো কাজগুলোর দেখভাল মেয়র ডন কলিন্সকেই করতে হয়। শহরের বাসিন্দা চার জন হলে কি হবে, প্রতি বছর প্রচুর পর্যটক আসেন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর এই ছোট্ট শহরটিকে দেখতে। এখানকার জাদুঘরটিও যথেষ্ট আকর্ষনীয়। শহরের অতীত ইতিহাস ধরা আছে এই সংগ্রহশালায়। মার্গারেটের ৪০-তম জন্মদিনে ডন এটি উপহার দিয়েছিলেন তাঁর স্ত্রীকে। তিনি এর নাম রেখেছেন, ‘দ্য ওয়ে উই ওয়্যার’ বাংলায় তর্জমা করলে দাঁড়ায় ‘আমরা যেমন ছিলাম’

        এক সময় এই শহরে সিনেমা হল, পানশালা ইত্যাদি নানা ধরনের বিনোদনের ব্যবস্থা থাকলেও এখন সে সব কিছুই নেই। এমনকী ইন্টারনেট কানেকশনও নেই। তাই শহরের চার বাসিন্দাকে অবসর সময় কাটাতে হয় মুখোমুখি বসে আড্ডা, গান, গল্প করে

        এক খুদে সদস্যের কথা না বললে লেখাটা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। সে হল কলিন্স দম্পতির নাতি। যদিও সে সারা বছর এই রূপকথার শহরে থাকে না। অন্য শহরে পড়াশোনা করে। সেখানেই থাকে। স্কুলের ছুটির দিনগুলিতে চলে আসে দাদু-দিদার কাছে। নৌকোয় চড়ে, জঙ্গলে ঘুরে মজায় কাটে সে ক’টা দিন

        চার সদস্যেরই বয়স বাড়ছে। তাই তাদের এখন একমাত্র চিন্তা সাধের টিল্ট কোভে ছেড়ে চলে যেতে হবে না তো একদিন?

 


মার্গারেট এবং ডন কলিন্স, সম্প্রদায়ের এক তৃতীয়াংশ, টিল্ট কোভে তাদের শেডে।

 


ডন কলিস,কমিউনিটি মিউজিয়াম যা তার এবং মার্গারেটের বাড়িতে ।

 


টিল্ট কোভ খনির সাথে অনেক পর্যটকের পারিবারিক সংযোগ, তাই পারিবারিক জিনিস-পত্র রেখে যান যখন তাদের আত্মীয়রা সেখানে থাকতেন । এই ক্ষেত্রে, এটি ১৯ শতকের স্কেটিং বেডের একটি সেট।

 


১৯ শতকের টিল্ট কোভের কবরস্থানে একটি সমাধি পাথর ।