অংশুমান চক্রবর্তী

  

                                                                                                                                                                                                                  ছবি - দেবাশিস সেন

  থেকে যাবে ভবানীপ্রসাদ          মজুমদারের ছড়া









অংশুমান চক্রবর্তী




 

                                              


স্বীকৃতি দিয়েছিলেন স্বয়ং সত্যজিৎ রায়। তিনি ‘সুকুমার রায় শতবার্ষিকী পুরস্কার’ স্বর্ণপদক পরিয়ে দিয়েছিলেন ভবানীপ্রসাদ মজুমদারের গলায়। ১৯৮৮-র ২ এপ্রিল। কলকাতার অবন মহলে। ‘সন্দেশ’ পত্রিকা আয়োজিত সুকুমার রায় জন্মশতবর্ষের সমাপ্তি অনুষ্ঠানে। ছিলেন লীলা মজুমদার, নলিনী দাস প্রমুখ। পূর্ণ প্রেক্ষাগৃহে গুণীজন সমাবেশে বাবার যোগ্য উত্তরসূরিকে বরণ করে নিয়েছিলেন বিশ্ববরেণ্য চলচ্চিত্র পরিচালক। রত্ন চিনতে ভুল হয়নি তাঁর।

     ভবানীপ্রসাদ মজুমদার বলতেন, ‘গুরু আমার রায় সুকুমার’। তিনি এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন সুকুমারীয় ননসেন্স ধারা। ‘আবোল তাবোল’-এর স্রষ্টার নামাঙ্কিত পুরস্কারপ্রাপ্তি তাঁকে দারুণভাবে উদ্বুদ্ধ করেছিল। আরও মনোযোগী হয়েছিলেন লেখায়। লেখা মানে মূলত ছড়া। সারাজীবন ধরেই ভবানীপ্রসাদ মজুমদার করে গেছেন ছন্দছড়ার সাধনা। তাঁর ছড়া থেকে গড়িয়ে পড়ত হাস্যরস। মজার ছড়ার পাশাপাশি লিখেছেন পশু-পাখি, ফুল-ফল, ভূত-প্রেত, গ্রাম-শহর, স্বাস্থ্য-বিজ্ঞান প্রভৃতি বিষয়ে ছড়া। পাশাপাশি লিখেছেন জীবনবোধের ছড়া, দেশাত্মবোধক ছড়া, মনীষীদের স্মরণে ছড়া, ভাষা আন্দোলনের ছড়া, প্রতিবাদী ছড়া। ছড়া নিয়ে নিরন্তর পরীক্ষানিরীক্ষা করেছেন। খেলেছেন ছন্দ নিয়ে। ছোটোদের পাশাপাশি বড়োদের জন্যও লিখেছেন। ঘুম পাড়ানির পাশাপাশি রচনা করেছেন ঘুম ভাঙানি বা ঘুম তাড়ানি ছড়া। বলেছেন সমাজের কথা। সামাজিক বৈষম্যের কথা। খুঁটিয়ে দেখতেন। ছড়ার মধ্যে দিয়ে ফুটিয়ে তুলতেন মানুষের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। বুনে দিতেন শ্লেষ, বিদ্রুপ। কিছু কিছু অন্ত্যমিল রীতিমতো চমকে দেয়। তাঁর প্রকাশিত ছড়ার সংখ্যা প্রায় ২০ হাজার। তিনি যত ছড়া লিখেছেন, তত ছড়া সম্ভবত বাংলা ভাষায় আর কোনও কবি লেখেননি। কিছু কিছু গদ্য কবিতাও লিখেছেন। লিখেছেন কয়েকটি গল্পও।

     লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন। সম্পাদনা করেছেন কয়েকটি ছড়া-পত্রিকা। পরবর্তী সময়ে দৈনিক সংবাদপত্র ও জনপ্রিয় পত্রিকার ছড়ার বিভাগ এবং ছোটোদের পাতার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব সামলেছেন। তাঁর হাত ধরে উঠে এসেছেন এক ঝাঁক ছড়া শিল্পী। শহর এবং গ্রামগঞ্জ থেকে। তাঁদের অনেকেই আজ ছড়ার জগতে সুপ্রতিষ্ঠিত। একটা সময় তাঁর পরিচালিত ছড়াগড়া প্রতিযোগিতা আলোড়ন তুলেছিল। বহু বিজ্ঞাপনে ব্যবহার করা হত তাঁর ছড়া। তাঁর বেশ কিছু ছড়া মুখে মুখে ফেরে। যেমন ‘বাংগালি বাবু বাংলামে কাবু’, ‘ছাগলের কাণ্ড’, ‘হরিণামের পরিণাম’, ‘জীবন জয় মরণ ভয়’, ‘আঙুল চোষার ফ্যাসাদ’ ইত্যাদি। উল্লেখযোগ্য ছড়ার বই ‘মজার ছড়া’, ‘সোনালী ছড়া’, ‘কোলকাতা তোর খোল খাতা’, ‘হাওড়া-ভরা হরেক ছড়া’, ‘ডাইনোছড়াস’, ‘ছড়ায় ছড়ায় সত্যজিৎ’, ‘রবীন্দ্রনাথ নইলে অনাথ’, ‘নাও ফুল নজরুল’, ‘রক্তে-ভাসা বাংলা-ভাষা’, ‘টাপুর টুপুর ছড়ার নূপুর’, ‘হাসতে হাসতে ভাসতে ভাসতে’, ‘ছড়ার ভিড় আবৃত্তির’। তাঁর ছড়া স্থান পেয়েছে পাঠ্যপুস্তকেও। এই সময়ে বাংলা ভাষায় এমন কোনও আবৃত্তি শিল্পী নেই, যিনি কবি ভবানীপ্রসাদ মজুমদারের ছড়া-কবিতা উচ্চারণ করেননি। আট থেকে আশি, সবার মনে তুলেছিলেন ছন্দের ঢেউ।

     সুকুমার রায় জন্মশতবর্ষ স্মৃতি পুরস্কার ছাড়াও পেয়েছেন পশ্চিমবঙ্গ সরকার প্রদত্ত উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী পুরস্কার। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপস্থিতিতে তাঁকে পুরস্কৃত করেন শিশু কিশোর আকাদেমির চেয়ারপারসন অর্পিতা ঘোষ। এ ছাড়াও পেয়েছেন পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি প্রদত্ত অভিজ্ঞান ছড়া পুরস্কার-সহ অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা।

     মানুষ হিসেবে ছিলেন সহজ-সরল। অমায়িক। তুমুল জনপ্রিয়তা পেলেও, স্পর্শ করেনি অহংকার। তাঁর বাড়িতে সবার ছিল অবারিত দ্বার। রাজ্যের কোনায় কোনায় কারা কারা ছড়া লিখছেন, খবর রাখতেন। বিশেষ পছন্দ করতেন নতুনদের। কেউ ভালো লিখলে খুশি হতেন। উৎসাহ দিতেন। বহুজনকেই হাতে ধরে লিখতে শিখিয়েছেন। শুধরে দিয়েছেন ভুলত্রুটি। দুঃখের বিষয়, অনেকেই মনে রাখেননি।

    জন্ম ১৯৫৩ সালের ৯ এপ্রিল। হাওড়া শহরে। শিক্ষকতা করতেন হাওড়ার শানপুর কালীতলা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। যাপন করছিলেন অবসর জীবন। আপনভোলা মানুষ। ছোটোদের সঙ্গে মিশে যেতেন সহজেই।

ভবানীকাকুর সঙ্গে আমার বাবা (অশ্রুরঞ্জন চক্রবর্তী )।

 ব্যক্তিগতভাবে আমি তাঁর স্নেহ পেয়েছি। আমার বাবা অশ্রুরঞ্জন চক্রবর্তী মোটামুটি তাঁর সমসাময়িক কবি। যদিও বাবা বয়সে কিছুটা বড়ো। বন্ধুত্বের অন্যতম কারণ, দুজনেই ছড়ার জগতের মানুষ এবং হাওড়া শহরের বাসিন্দা। দুজনেই একটা সময় জড়িয়ে ছিলেন অভিনব অগ্রণী সাহিত্য গোষ্ঠীর সঙ্গে। আমি ভবানীপ্রসাদ মজুমদারকে প্রথম দেখি আটের দশকের শুরুতে। তখন আমি নেহাত শিশু। হাফ প্যান্ট । অভিনব অগ্রণীর একটি অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম বাবার সঙ্গে। হাওড়া ময়দানে অক্ষয় শিক্ষায়তন স্কুলে। আমি পাঠ করেছিলাম নিজের লেখা ছড়া। ভবানীপ্রসাদ মজুমদার ছিলেন সঞ্চালক। বাবা আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর সঙ্গে। সেদিন থেকে তিনি আমার 'ভবানীকাকু'। যদিও তাঁর ছড়ার সঙ্গে অনেক আগেই পরিচয় হয়ে গেছে।

    নিয়মিত যেতাম তাঁর বাড়িতে। ছড়া নিয়ে আলাপ আলোচনা হত। কেটে যেত দীর্ঘ সময়। পেয়েছি কাকিমার স্নেহ। বলা যায়, আমাদের পারিবারিক সম্পর্ক। আমাদের বাড়িতে ভবানীপ্রসাদ মজুমদার এসেছেন বহুবার। বাবার সঙ্গে আড্ডা দিতে, ঘরোয়া সাহিত্য সভায়, পারিবারিক অনুষ্ঠানে।

     ছড়ার জগতে তিনি ছিলেন একজন সেলিব্রেটি। পেয়েছেন খ্যাতি, সম্মান, পুরস্কার, মানুষের ভালোবাসা। তবে অহংকার স্পর্শ করেনি তাঁকে। একটা সময় সবার জন্য ছিল অবারিত দ্বার।

   তাঁর কয়েকটি বই আমি প্রকাশ করেছি আমাদের 'ছোটর দাবি' প্রকাশনী থেকে। 'ছোটর দাবি' পত্রিকার প্রায় প্রতিটি সংখ্যায় ছেপেছি তাঁর ছড়া। বড়ো অথবা বাণিজ্যিক পত্রিকার পাশাপাশি তিনি সমান গুরুত্ব দিতেন ছোটো পত্রিকাকে। বলতেন, 'দুই পাতার পত্রিকাতে লিখলেও জানবে কেউ না কেউ পড়ছে।'

     বাবার কবি-জীবনের ৫০ বছর পূর্তি অনুষ্ঠান হয়েছিল হাওড়ার সাতাশীতে। সাতরং সংস্থার উদ্যোগে। সেই অনুষ্ঠানে দীর্ঘ বক্তব্য রেখেছিলেন ভবানীপ্রসাদ মজুমদার। মনে আছে, পা ছুঁয়ে প্রণাম করেছিলেন বাবাকে। বাবা তাঁকে জড়িয়ে ধরেছিলেন বুকে। তৈরি হয়েছিল আবেগঘন মুহূর্ত। পরস্পরের প্রতি ছিল গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।

     আমরা বহু অনুষ্ঠানে একসঙ্গে গেছি। সে হুগলির বদনগঞ্জ হোক বা কলকাতার বাংলা আকাদেমি সভাঘর, কৃষ্ণপদ ঘোষ মেমোরিয়াল হল। সারা রাস্তায় কত গল্প। গাড়ি দাঁড় করিয়ে চা খাওয়া। মাঝে-মাঝেই মুহূর্তগুলো মনে পড়ে। কয়েক বছর আগে ১ নভেম্বর, বাবার জন্মদিনে বাবাকে নিয়ে একটা ছড়া লিখে পাঠিয়েছিলেন। সেটা পড়ে বাবা খুব খুশি হয়েছিলেন। অশ্রুরঞ্জন চক্রবর্তীর চোখে সেদিন আনন্দ-অশ্রু দেখেছিলাম।

     দীর্ঘদিন অসুস্থ ছিলেন ভবানীপ্রসাদ মজুমদার। চলছিল চিকিৎসা। আমি সময় সুযোগ পেলেই যেতাম। না-হলে ফোনে খোঁজ নিতাম। যতটা সম্ভব উৎসাহ দিতাম লেখার ব্যাপারে। জীবনে অনেক কিছু তাঁর কাছে শিখেছি, পেয়েছি। সেগুলো থেকে যাবে আমার মনের মণিকোঠায়।

     ২০২৪-এর ৭ ফেব্রুয়ারি ভবানীপ্রসাদ মজুমদার চলে গেলেন না-ফেরার দেশে। কবি চলে গেলেন। পাতায় পাতায় থেকে গেল তাঁর অসামান্য সৃষ্টি। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য। যতদিন বাংলা ভাষা থাকবে, বাংলা ছড়া থাকবে, ততদিন তিনি থাকবেন। অগণিত পাঠক-পাঠিকার মনে। কণ্ঠশিল্পীদের আন্তরিক উচ্চারণে

  

 

<