সিতাংশু কর

 

  প্রিয় ছড়াকার ও প্রিয় মানুষ      ভবানীপ্রসাদ মজুমদার









সিতাংশু কর





 

ভবানীপ্রসাদ মজুমদার দু-বাংলার ছড়া সাহিত্যে এক বিশাল মহিরুহ। এমন অতিপ্রজ ছড়াকার আর নেই, ছিলেন না। দু-হাতে লেখা বলতে আক্ষরিক অর্থে যা বোঝায়, ছড়াকার ভবানীপ্রসাদ মজুমদার তার এক জ্বলজ্যান্ত উদাহরণ। আশির দশক থেকে আমার লেখালেখির শুরু। যখন লিখতে শুরু করি, তখন ভবানীদা বেশ খ্যাতিমান ছড়াকার। প্রথমদিকে আমি তা জানতে পারিনি, কারণ ভবানীদা তখন বাংলাদেশের পত্রপত্রিকায় লিখতেন না; আর আমি তখনও কেবল বাংলাদেশের কাগজেই লিখি

অবশ্য বেশ দ্রুতই আমি পশ্চিমবঙ্গের কাগজের সুলুকসন্ধান বের করে ফেলি। সেখানে লিখতেও শুরু করি। আশির দশকের প্রথমার্ধে একটি শিশুদের পত্রিকা বের করবার প্রস্তুতি নিচ্ছি। নামনীলতারাবলে রাখি, আমার লেখালেখির হাতেখড়ি ছড়া দিয়েই। তাই স্বভাবতই ছড়ার প্রতি আমার দুর্বলতা বেশি। আমার কাগজটিতে শেষ পর্যন্ত শুধু ছড়া ছাপানোর সিদ্ধান্ত হয়। আমি চাইছিলাম, বাংলাদেশের লেখার পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গের ছড়াকারদের ছড়াও আমার কাগজে থাকুক। কিন্তু তখন পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের তেমন কোনও ছড়াকারের সঙ্গে আমার ভালো পরিচয় ছিল না। অবশ্য তখন পুরুলিয়া থেকে প্রকাশিত ত্রৈমাসিকটুকলুও মাসিকটুকলুছড়া কার্ডে আমি নিয়মিত লিখি। এ-পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন হারাধন কর, আর কর্মাধ্যক্ষ ছিলেন অমল ত্রিবেদী। প্রয়াত শ্রদ্ধেয় ছড়াকার অমল ত্রিবেদী অত্যন্ত বন্ধুভাবাপন্ন মানুষ। তাঁর হাতের লেখা ছিল অত্যন্ত সুন্দর। আমার সঙ্গে তাঁর নিয়মিত পত্রালাপ ছিল। আমার অনুরোধে অমলদা পশ্চিমবঙ্গের বেশ কয়েকজন ছড়াকারের ছড়ার হাতে লেখা স্ক্রিপ্ট পাঠালেন। তাঁদের মধ্য থেকে বড়ো আকারের একটি ছড়া আমাকে অভিভূত করে। সেটি শ্রদ্ধেয় ভবানীপ্রসাদ মজুমদারের ছড়া। সে-ছড়া পড়েই অনুমান করেছিলাম তিনি অত্যন্ত বড়ো ছড়াকার। যদিও ভবানীদার ওরকম ছড়ার সংখ্যা কম নয়, স্বীকার করতেই হবে, এমন শুদ্ধ সাবলীল ছড়া লেখা চাট্টিখানি কথা নয়। ছড়াটির নাম ছিলপ্রভুভক্ত কুকুর বটেপুরো ছড়াটিই তুলে দিলাম।—

এটাই নেবেন? ঠিক চিনেছেন,

বিষম প্রভুভক্ত!

লাখ দু-লাখে এমন কুকুর

একটা মেলাও শক্ত!

সত্যি দাদা, এমন কুকুর

পাবেন না আর খুঁজে!

ঠকাচ্ছি না মোটেও আমি

যান নিয়ে চোখ বুজে!

এমন কুকুর খুঁজে পাওয়া

নয়কো মোটেই সোজা!

চুপিচুপি বলছি শুনুন

তবেই যাবে বোঝা!

এই বছরেই উনিশটি বার

বিক্রি করে ওকে

দেড়শো টাকা প্রতিবারেই

পেলাম থোকে থোকে!

যতবারই বিক্রি করি

চেনটা গলার ছিঁড়ে

তিনদিন না যেতে যেতেই

আসে ও ঠিক ফিরে!

তবেই বুঝুন প্রভুভক্ত

কুকুর কারে কয়!

এটাই নেবেন? পালান কেন?

নেই ঠকবার ভয়!

পশ্চিমবঙ্গ থেকে ভবানীদা ছাড়াও অমল ত্রিবেদী, গৌতম গলুই, হাননান আহসান প্রমুখ ছড়াকারের ছড়া স্থান পায় আমার পত্রিকায়

 


পরে একসময় আমি কলকাতারকিশোর ভারতী’-সহ পশ্চিমবঙ্গের সকল জেলার লিটল ম্যাগে লিখতে শুরু করি। ইতোমধ্যে ভবানীদার সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠ পরিচয় হয়ে যায়। অমলদার মতো ভবানীদাও তখন কিছু কিছু পত্রিকা আমার জন্যে পাঠাতেন। ওসব পত্রিকার প্রায় প্রতিটিতে তিনি হয় সম্পাদক, নয়তো উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্বরত। পত্রিকাগুলোর প্রচ্ছদ পৃষ্ঠায় তিনি অত্যন্ত যত্ন করে লিখে দিতেন—স্নেহসুন্দর ভাই শ্রী সিতাংশুবিকাশ করকে; তারপর লিখতেন ভবানীদা। সঙ্গে একটি তারিখ। উল্লেখ্য, আশির দশকের একটা বড়ো অংশ পর্যন্ত আমি সিতাংশুবিকাশ কর নামেই লিখেছি। পরেবিকাশশব্দটি বর্জন করি নামটি ছোটো করার জন্য

আমার গর্ব হয় এ ভেবে যে, যে-ছড়াকার ছড়ার সংখ্যায় পৃথিবীতে প্রথম স্থানে অবস্থান করছেন, যাঁর ছড়া সমূহের একটা বড়ো অংশই নিশ্চিতভাবে কালোত্তীর্ণ, তাঁর স্নেহধন্য ছিলাম আমি। তাঁর সঙ্গে যোগাযোগে মনে হত তিনি মাটির মানুষ। পত্র যোগাযোগই তখন সবচেয়ে জনপ্রিয়। ভবানীদা কোনও না কোনও পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে তাঁর নামাঙ্কিত প্যাডে চিঠি লিখতেন। ঠিকানা ছিল—ডাকঘর: দাশনগর, জেলা: হাওড়া

টুকলুপত্রিকার আমি নিয়মিত লেখক ছিলাম। একসময় বাংলাদেশ প্রতিনিধি হই। এ-পত্রিকার প্রত্যেক সংখ্যায় দেখতাম ভবানীদার ছড়া আছেই; তাও একটি দুটি ছড়া নয়, পুরো এক পৃষ্ঠাব্যাপী তাঁর চার-পাঁচটি ছড়া ছাপা হত। দীর্ঘকাল দেখেছি, পশ্চিমবঙ্গের প্রায় সব ছোটোদের পত্রিকার প্রতি সংখ্যায় ভবানীদার কয়েকটি করে ছড়া থাকছেই

ভবানীদার ছড়া অবচেতনে আমাকে প্রভাবিত করে থাকবে; কারণ একটা দীর্ঘ সময় আমি বাংলাদেশে যত না লিখতাম, তার চেয়ে বেশি লিখতাম পশ্চিমবঙ্গে। প্রিয় ছড়াকার ভবানীপ্রসাদ মজুমদার ও আমার গুরুতুল্য শ্রদ্ধেয় ভবানীদাকে মহান সৃষ্টিকর্তা সুস্থতা ও দীর্ঘায়ু দান করুন, এ কামনা

  

<