ড. আশিস কুমার নন্দী

  


      ছড়া শিল্পী ভবানীপ্রসাদ               মজুমদার









ড. আশিস

কুমার নন্দী





 

আজ থেকে বেশ কয়েক বছর আগে শিয়ালদার কাছে ব্যাপটিস্ট মিশন হলেসম্পর্কের শিকড়পত্রিকার একটি অনুষ্ঠানে সম্মুখ সাক্ষাৎ। এখানে অন্যতম বৈশিষ্ট্যপূর্ণ পুরস্কারমানবিক মুখপুরস্কার দেওয়া হবে আমাকে। কার্ডে জ্বলজ্বল করছিল ছড়া সম্রাটভবানীপ্রসাদ মজুমদারনামটি। উনিই অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন। বিন্দুমাত্র দ্বিধা নয়, দেরিতে পৌঁছানো নয়, অনুষ্ঠানের একঘণ্টা আগে পৌঁছে গেলাম। হলে গিয়ে উশখুশ করছি কখন আসবেন। মিনিট কুড়ি অপেক্ষার পর একটা গাড়িতে পত্রিকা সম্পাদকের সাথে ওঁর আগমন। বিস্ময়-বিস্ফারিত চোখে দেখছি। ছবিতে বহুবার দেখেছি তাই চিনে নিতে অসুবিধা হয়নি। কবি কৃষ্ণা বসু ছিলেন সঙ্গে। হাসতে হাসতে বললেন, ‘ছড়া সম্রাটের প্রবেশ। ভাবা যায়! এই মানুষটি প্রায় কুড়ি হাজারেরও বেশি ছড়া লিখেছেন!বিস্ময়ের বিস্ময়! মুগ্ধতা নিয়ে দেখা বার বার। কাছে গিয়ে প্রণাম করলাম। হাতেই ধরা ছিল ছড়ার বই একটা। দিলাম ওঁকে। হাসিমুখে নিয়ে ব্যাগে রেখে দিলেন। আশীর্বাদের হাত মাথায়। ভবানীপ্রসাদ মজুমদার এত সাধারণ! মহত্ব, মানবিকতা ঝরে পড়ছে ওঁর আচার-আচরণ, ব্যবহারে। এই মানুষটির কাছ থেকেমানবিক মুখপুরস্কার নেওয়া সার্থক। অনুষ্ঠানের আগে পরে অনেক গল্প। উপদেশ, পরামর্শ পেলাম। যাঁর ছড়া পড়েছি, পড়িয়েছি, তাঁকে সামনে, কাছে পাওয়ার মুহূর্তটা একটা অদ্ভুত ভালো লাগার আবেশ। পরে পরে আরও অনেকবার দেখা হয়েছে। কথা, হাসি, গল্প হয়েছে। একসঙ্গে ছড়া সংকলন সম্পাদনা করেছি। ওঁর সম্পাদিত সংকলনগুলিতে লেখা দিয়েছি। যখন ইচ্ছে চলভাষে কথা বলেছি। হঠাৎই মনে হয়েছে একবার কেমন আছেন খোঁজ নিই। যেখানেই থাকুন, যে অবস্থায় থাকুন, কথা বলেছেন। বিরক্তি, রাগ, উত্তেজনা কখনও তাঁর মধ্যে দেখিনি

একটা ঘটনার কথা বলি। ক্লাসে তাঁরই লেখাদারোগাবাবু এবং হাবুছড়াটা পড়াচ্ছি। ছেলেদের বললাম, ‘এই ছড়াটা যাঁর লেখা, তাঁকে আমি চিনি। অনেকবার দেখা হয়েছে।ছেলেদের চোখে অবিশ্বাসের ছবি। পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে টিপে দিলাম সুইচ। তারপর ও-প্রান্তে ছড়া সম্রাটের গলা। লাউড স্পিকার দেওয়াই ছিল। ফোনে কথা বলতে বলতে উনিও যেন শিশু হয়ে গেছেন। বাচ্চাগুলোর কথা তো ফুরোতেই চায় না। উনিও মজা করে চলেছেন। আমি বাচ্চাদের বোঝালাম, উনি খুব ব্যস্ত মানুষ। পরে আবার কথা হবে। প্রণাম জানালাম ফোনেই। সেদিনও বললেন, ‘ভালো থেকো আশিস। আমার আশীর্বাদ রইল। আশিসকে আশিস।

গল্প, প্রবন্ধ, কবিতা লেখার সঙ্গে সঙ্গে ছড়াও লিখতে হয় মাঝে-মধ্যেই। অলক্ষ্যে যেন তিনি এসে দাঁড়ান, সতর্ক দৃষ্টি নিয়ে। স্বরবৃত্তের জাদুকর ভবানীপ্রসাদ মজুমদার। শব্দ নিয়ে খেলা। মজার ভঙ্গিতে সামাজিক বার্তা দেওয়ার চেষ্টা কখনও। যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে একবার ছড়ার কর্মশালা হয়েছিল। তিনি ছিলেন মূল আকর্ষণ। প্রত্যেকে দুটি করে ছড়া জমা দিয়েছিলাম। নাম ধরে ধরে বিশ্লেষণ করেছিলেন উনি এবং আর একজন প্রথিতযশা সাহিত্যিক পবিত্র সরকার। ভবানীপ্রসাদবাবুর কাছে জানা গিয়েছিল অনেক অনেক কিছু। কীভাবে ছড়াকে ছড়িয়ে দেওয়া যায় সবার মাঝে, সে-বিষয়ে তিনি এক এবং অনন্য। বিষয়গত বৈচিত্র্যে যেমন ভরপুর, তেমনি ছন্দময়। সুনিপুণ চিত্রকরের মতো ছড়ায় চিত্রকল্প এঁকেছেন সাবলীল ভঙ্গিতে। সামাজিক সমস্যা তুলে ধরেছেন। সাধারণ ঘরোয়া বিষয় বর্ণিত হয়েছে। হাসতে হাসতে তিনিই বলতে পারেন—

এই যে, ফুল পাখি আকাশ চাঁদ তারা নক্ষত্র পাহাড় ঝর্ণার মাঝে ছড়িয়ে আছে ছড়া।

ভবানীপ্রসাদ মজুমদারের অন্তর্লোকে এক নিষ্পাপ শিশুর বাস। যে শিশু মরণের ভয় জানে না। যে শিশু জট-জটিলতা চেনে না। স্পষ্ট কথা কষ্টে উচ্চারিত হয় না। ভালোলাগা ভালোবাসার কথা বলছেন—

ভালো লাগে আকাশের রং নীল-নীল

পাহাড়-সাগর-নদী খুশি ঝিলমিল

ভালো লাগে ছোটাছুটি, খেলা লুকোচুরি

ভালো লাগে লুডো-জুডো, ডাংগুলি ঘুড়ি।

ভূত নিয়ে ছড়া লিখেছেন মজার ছলে—ভূতরা রাতে মজায় মাতে’, ‘ভগবানের ভূত’, ‘ভূতের বুদ্ধিইত্যাদি। ছড়ায় ছড়ায় মজা করে ভূতপূর্ব, ভূতশুদ্ধি, ভূততুতো, ভূতশ্রাদ্ধ ইত্যাদির অদ্ভুত সুন্দর ব্যাখ্যা দিয়েছেন। হাসি-মজা-রসিকতা শুধু নয়, জীবনের সমস্যাসংকুল পরিস্থিতির নিরসনের চেষ্টায় আছে ছড়া। অনায়াস সাবলীল ভঙ্গিতে শব্দের মেলবন্ধনে সেই ছড়াকে তুলে আনেন লেখনীর অগ্রভাগে। বিরলতম প্রতিভা

ইংরেজির প্রতি আগ্রহ, বাংলাকে ভুলে যাওয়ার ইচ্ছে—কষ্ট পেয়েছেন। ছড়ায় তা প্রকাশ করেছেন। হিউমারকে অবলম্বন করে যে ছড়া উপহার দিয়েছেন, নিঃসন্দেহে তা হৃদয় ছুঁয়ে যায়। একটা শিক্ষা। একটা কশাঘাত। বর্তমান সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে অত্যন্ত সত্যি—বাংলাটা ঠিক আসে নাবাংলা ভাষা তুচ্ছ, অবহেলিত

বেঙ্গলি থার্ড ল্যাঙ্গুয়েজ তাই, তেমন ভালোবাসে না

জানেন দাদা, আমার ছেলের বাংলাটা ঠিক আসে না।

মাতৃভাষার প্রতি অবমাননা দেখে দুঃখ পেয়েছেন। বাংলা তথা বাঙালির কাছে তিনি বড়ো কাছের জন। বাঙালির মনস্তত্ত্ব বোঝেন। গ্রামের ছায়ায় মায়ায় মানুষ হয়েছেন

১৯৫৩ সালের ৯ই এপ্রিল পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া জেলার জগাছা থানার অন্তর্গত দাশনগরের কাছে দক্ষিণ শানপুর গ্রামে জন্ম। পিতা নারায়ণচন্দ্র মজুমদার। মাতা নিরুপমা দেবী। পেশায় শিক্ষক। শিক্ষকতার ফাঁকে-ফাঁকেই ছড়া নিয়ে গবেষণা তাঁর। পরীক্ষানিরীক্ষা গবেষণাই তো! কতরকমের কত বিষয় নিয়ে লেখা


 

ছদ্মনাম নিয়েছেন—বেচারাম বাচস্পতি, কেনারাম কাব্যতীর্থ, মোল্লা হাসিরুদ্দিন। কিন্তু তাতে ভবানীপ্রসাদ মজুমদারকে চিনতে জানতে পাঠকের অসুবিধা হয়নি কখনও। পাঠক ঘরানা চেনে। লেখকের লেখনীই বহন করে তাঁর পরিচয়, যতই তিনি থাকুন নেপথ্যচারীতায়

তাঁরমজার ছড়া’, ‘সোনালি ছড়া’, ‘কোলকাতা তোর খোল খাতা’, ‘হাওড়া-ভরা অনেক ছড়া’, ‘মিঠে কড়া শ্রেষ্ঠ ছড়াবাংলা সাহিত্যের সম্পদ-সম্ভার। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে শ্রদ্ধা জানিয়ে লেখা ছড়া গ্রন্থরবীন্দ্রনাথ নইলে অনাথঅসাধারণ এক উপহার পাঠকের কাছে। একটা কথা আমরা ভালো করেই জানি, শিশুর মন জয় করা এত সহজ নয়। শিশুর কোমল হৃদয়ে ঠাঁই পেতে হলে জাদুকরী প্রতিভার অধিকারী হতে হয়। তিনি সক্ষম হয়েছিলেন শিশুর অন্তর জয় করতে। শব্দ যেন জব্দ তাঁর কাছে।সবার চেয়ে ভালোছড়ায় লিখেছেন—

সৃষ্টি ছাড়া     বৃষ্টি ভালো

দই সন্দেশ    মিষ্টি ভালো

চড়ুইভাতি     ফিষ্টি ভালো

টাটকা ইলিশ  ফিশ-টি ভালো

 

জুতো কেনার গুঁতোপড়ে একটা নির্মল পবিত্র হাসি জাগে ওষ্ঠে।—

জুতোওলা বললে তবে

দিন বগলের মাপ,

ক্রেতা রেগেই বলেন ছি ছি

ইস্ কী মহাপাপ

 

জুতোওলা বললে মশাই

করেন কেন ছি ছি,

সাতসকালেই আমার উপর

চটেন মিছিমিছি

 

ডোবাগ্রাম তো সারাবছর

ডুবেই থাকে জলে,

জুতো কি আর পায়ে দেবেন

থাকবে তো বগলে।

 

স্বাধীনতার মানেছড়ায় যে আক্ষেপ ঝরে পড়েছে তা বঞ্চিত জনতার ভাষ্য। ছেলেটা কিংবা মেয়েটা সবটুকু অসহায়ত্ব নিয়ে আমাদের কাছে প্রতীকী প্রশ্ন রেখেছে—

যে ছেলেটা রেস্তোরাঁতে ধুচ্ছে থালা-গেলাস-বাটি

যে ছেলেরা সারাজীবন খায় লাথি-কিল-চড় ও চাঁটি

ওদের কাছে প্রশ্ন কোরো, ওরা কি কেউ সত্যি জানে

স্বাধীনতা কাকে বলে, স্বাধীনতার সঠিক মানে?

 

যে মেয়েটা ভোর না হতেই মায়ের সাথে যাচ্ছে কাজে

যে মেয়েটা পরের বাড়ি কাপড় কাচে, বাসন মাজে,

যে মেয়েটা গোবর কুড়োয়, ঘুঁটেও দেয়, কয়লা বাছে

যে মেয়েরা পায় না আদর সারাজীবন কারোই কাছে

ওদের কাছে প্রশ্ন কোরো, ওরা কি কেউ সত্যি জানে

স্বাধীনতা দেখতে কেমন? স্বাধীনতার সঠিক মানে?’

একটা সামাজিক বার্তা পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা। চেতনা ফিরিয়ে দেওয়ার প্রয়াস



শিশুকিশোর মনে প্রশ্ন জাগবে—রিজিয়া কে? হোমার কে? জুলিয়াস সিজারের সম্পর্কে কৌতূহল জন্ম নেবে। অথচ মজার ছলে বলাহিস্ট্রির হিস্টিরিয়া’-তে—

পারো যদি দেখে নিও ইতিহাস পড়িয়া

বেড়াতেন কোন রাজা ঠেলাগাড়ি চড়িয়া

সুলতানা রিজিয়া

বৃষ্টিতে ভিজিয়া

কবে কোথা হেঁচে হেঁচে হয়েছিল মরিয়া?’

 

ভালো করে খুঁজে দেখো ইতিহাস ঘাঁটিয়া

জুলিয়াস সিজারের কটা ছিল খাটিয়া?

হোমারের ভাগনা

কবে কোথা মাগনা

ঘুগনির শালপাতা খেয়েছিল চাটিয়া?’

 

শব্দ নিয়ে খেলার মাঝেই মানুষের চরিত্র, দিনলিপি, খণ্ড চিত্র তুলে ধরার অসাধারণ ক্ষমতা সবার থাকে না

কাটাকুটির মজায় দেখি—

বুড়োবুড়ি তিলক কাটে

চ্যাঙড়া কাটে তেড়ি,

মুখে মুখেই ছড়া কাটে

পঞ্চি, ভূতি, নেড়ি!

 

ময়রা দুধের ছানা কাটে

সুতো কাটে জোলা,

সারা দুপুর সাঁতার কাটে

গণশা, ভূতো, ভোলা।

এই ছড়াতেই লিখছেন—

অঙ্ক কাটা, মাইন্নে কাটা

পুজোয় কাটাই ছুটি,

সারাটা দিন সেলেট নিয়েই

খেলছি কাটাকুটি।

এখানে কি একটু দার্শনিকতার ছোঁয়া? জীবনটাই তো আমাদের কাটাকুটির খেলা। মহান মানুষের মহত্ব, অবদানকে শ্রদ্ধাবনত চিত্তে স্মরণ করেছেন ছড়ার মাধ্যমে

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে নিয়ে লিখেছেন—

সাগর! সাগর! বিদ্যাসাগর! নেই

সাগরের শেষ

আজো সবাই তাই খুঁজে পাই

তোমার জ্ঞানের রেশ!

সাগর! সাগর! দয়ার সাগর! বিশাল

তোমার মন

বীরসিংহের সিংহশাবক সবার

আপনজন!

অননুকরণীয় রীতি। তাঁর স্টাইল বা তাঁর শৈলী তাঁর নিজস্বতায়।ছু-মন্তর দোলে অন্তরছড়া তার প্রমাণ।—

                        ছু-মন্তর       ছু-মন্তর           ছু-মন্তর

                    ছু

                    কলকাতাকে   কেউ বলে কু      কেউ বা বলেন

                    সু

                    শহিদ মিনার   ভিক্টোরিয়া         আলিপুরের

                    জু

                        চক্ররেলের     বক্রগতি          পু-ঝিক-ঝিক

                    পু

                            ছু-মন্তর       ছু-মন্তর           ছু-মন্তর

                    ছু


স্বপ্ন চুরি হলে কার না দুঃখ হয় বলো! স্বপ্ন চুরি হলে কি শুধু খোকা-খুকুমণির কষ্ট? সবার দুঃখ। সবার কষ্ট। চাই-ই তো, আমাদের স্বপ্ন ভেসে থাক আমাদের চোখের তারায়।স্বপ্নচুরি’-তে লিখেছেন—

হারিয়ে গেছে আকাশ-বাতাস, পাহাড়-সাগর-নদী

হারিয়ে যাওয়া সেইসব দিন পাই ফিরে ফের যদি

বুকে সুখের দোলনা দোলায় বুড়ো বটের ঝুরি

স্বপ্ন গেছে চুরি আমার, স্বপ্ন গেছে চুরি।

হারিয়ে যাওয়া দিনের মধুর স্মৃতি বড়ো মনে পড়ে। ছুঁতে ইচ্ছে করে খুব। আবার এখানেই এসেছে ক্যারিয়ারের জন্য স্বপ্ন বিসর্জন দেওয়ার কথা। বাচ্চার বাহাদুরি তখনই, যখন সে লেখাপড়ায় কৃতিত্ব দেখাবে। বাবা-মায়ের স্বপ্ন সফল করতে গিয়ে নিজের স্বপ্নটাই কখন যে চুরি হয়ে গেছে! মর্মবেদনার প্রকাশ—

নেই দেরি আর, চাই কেরিয়ার, বাবার জারিজুরি

স্বপ্ন গেছে চুরি আমার, স্বপ্ন গেছে চুরি।

 

বাংলা ভাষার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে তিনি লিখেছেনআ মরি বাংলাভাষাছড়া—

যে ভাষায় বাউল-জারি-সারি

যে ভাষায় লালন-ভাটিয়ালি

যে ভাষায় ঝুমুর-টুসু-ভাদু

বুকেতে বাজায় সুখের তালি

যে ভাষায় তরজা-কবিগান

যে ভাষায় যাত্রা-পদাবলি,

যে ভাষায় পাঁচালি-কীর্তন

ভাওয়াইয়া শোনায় কথাকলি

যে ভাষায় ভায়ের রক্তে ভাসা

যে ভাষায় মায়ের অশ্রু ঠাসা,

মোদের গরব, মোদের আশা

আ মরি বাংলা ভাষা।

এখানে ফুল্লরা-খুল্লনা, বেহুলা-লখীন্দর, সোনাই-কাজলরেখা, মা মেনকা, উমা, লাউসেন-কালকেতু, কঙ্ক-লীলা-কালুর কথা এনেছেন ভবানীপ্রসাদ মজুমদার। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস, ইতিবৃত্ত মনে করিয়ে দিয়েছেন। এই চরিত্র, তাদের কথোপকথন, এই গাথা, এই কাহিনি—সবই বাংলার সঙ্গে, বাংলা ভাষার সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য

 

অনেকেই যাঁরা ইদানীং ছড়া লিখে চলেছেন, তাঁদের কাছে নিঃসন্দেহে তিনি গুরুস্থানীয়। ভবানীপ্রসাদ মজুমদারের অন্তর্দৃষ্টি, গভীর পর্যবেক্ষণ শক্তিকে সাধুবাদ জানাতেই হয়। তীব্র, তীক্ষ্ণ বিশ্লেষণ ক্ষমতা না থাকলে জীবনের জলছবি চোখে ধরা পড়ে না। মুখে মুখে ছড়িয়েছিল ছড়া একদিন গ্রামবাংলার পথে প্রান্তরে। কতরকম ছড়া। পুজো, গাজন, মেলা, পরব-পার্বণ, টুসু, ভাদু, রথ নিয়ে ছড়া। তারপর অনেকটা পথ পেরিয়ে সাহিত্যে ঠাঁই হল তার। আমরা পেলাম এই মহান ছড়া শিল্পীকে। ছড়াকে কৌলীন্য দান করলেন। তাঁর কীর্তি চির-ভাস্বর। তাঁর ছড়া যেন অক্ষরমালায় সাজানো শব্দের বাগান। বর্ণমালার নৃত্যশৈলী। প্রেমহীন ভারতবর্ষের রিক্ত রূপ দেখে কষ্ট পেয়েছেন। জাতি-ধর্ম-সম্প্রদায়ের ভেদাভেদ, ক্ষুধার্ত মানুষের হাহাকার দেখে সচেতন করতে চেয়েছেন।জননী জন্মভূমিশ্চছড়ায় বলছেন—

পেরিয়ে গিয়েছি স্বাধীনতার ওই অর্ধশতক বর্ষ

আজও কি সবাই পেয়েছি মনেতে সুখ-শান্তির স্পর্শ?

আজও জাতি-ভেদ, ধর্ম-বিভেদ নিয়ে হয় মারামারি

দু-মুঠো ভাতের তরে কুকুরের সাথে চলে কাড়াকাড়ি!

কোন ভারতবর্ষের স্বপ্ন দেখেছেন তিনি? লিখেছেনভারতবর্ষ, হোক আদর্শ’-তে। এই স্বপ্ন তো আপামর ভারতবাসীর

ভারতবর্ষ তোমার-আমার তোমার-আমার

খেয়াল-ভজন, ঠুংরি-গজল, ধ্রুপদ-ধামার!

সবার প্রাণে, মিলন-গানে লাগাও স্পর্শ

ভারতবর্ষ - ভারতবর্ষ – ভারতবর্ষ।

 

ছড়া মানে লঘুকথা, ছড়া মানে চটুলতা, ছড়া মানে অন্ত্যমিলে শোনা কিছু পরিহাস—যারা এসব ভাবে, তাদের ভ্রান্তি দূর হবে নিশ্চিত এই যশস্বী ব্যক্তির ছড়াপাঠে। জীবনে জীবনকে মিশিয়ে দিতে না পারলে, গভীর অনুভবময়তা না থাকলে এমন লেখা সম্ভব নয়। উদারতা ছড়িয়ে মানবতার খোঁজ—আলো-আশা ভালোবাসা দিয়ে ঠাসা পৃথিবীটা একটাই দেশ হোক।বিশ্বমানবতার সন্ধানে ছড়া শিল্পী। দিনের শেষে বিচারে বসে যদি দেখি মানব কল্যাণের লেশমাত্র নেই যে লেখায়, সে লেখক বিসর্জিত হন কালান্তরে

ভবানীপ্রসাদ মজুমদার যুগে যুগান্তরে থাকবেন হৃদয়-সিংহাসনে। তাঁর ভাব-ভাবনা থাকবে আলোর দিশারি হয়ে। আলোর মানুষ হয়ে আলো ছড়িয়ে গেছেন, এ-কথা ভুলি কী করে! উজ্জ্বল নক্ষত্রসম দ্যুতি ছড়িয়েছে তাঁর রচনা।রবীন্দ্র সংগীত’, ‘পদ্মাবতী’, ‘রশ্মি রঙ্গিন নগরী’, ‘মধুকর্ণিকা’, ‘জন্মভূমি’ — কোনটা ছেড়ে কোনটার কথা বলি? হাজার হাজার লেখার মধ্যে ভালো-মন্দ বেছে নেওয়ার সাহস কারও কখনও হবে না। বাংলা সাহিত্যের মণিমাণিক্য সবগুলিই। সব পাঠকের সমান পছন্দ ভবানীপ্রসাদ মজুমদার। আট থেকে আশি, চোদ্দ থেকে চুয়াত্তর, তেরো থেকে তিরাশি তাঁর লেখার মুগ্ধ পাঠক। ভাবে-ভাষায়-ছন্দ-মাত্রা-মিল, বিষয়-বৈচিত্র্যে তাঁর সাহিত্য প্রতিভার স্ফুরণ। কখনও উইট, কখনও স্যাটায়ার, কখনও হিউমার। জীবনের প্রতি এত অনুরক্ত তিনি! অন্যায়, অবিচার, নীতিহীনতায় ঝলসে উঠেছে কলম। তীব্র শ্লাঘা হয়েছে হাতিয়ার। সাহিত্য তাঁর কাছে সাধনার ধন। অজস্র পুরস্কার সম্মাননা প্রাপ্তি ঘটেছে। জীবদ্দশাতেই কিংবদন্তি ভবানীপ্রসাদ মজুমদার। লাভ করেছেন সুকুমার রায় শতবার্ষিকী পুরস্কার, সত্যজিৎ পুরস্কার, সুকান্ত পুরস্কার, অমৃত কমল পুরস্কার, শিশুসাহিত্য সংসদ পুরস্কার, শিশুসাহিত্য পরিষদ পুরস্কার, ধূমকেতু স্বর্ণপদক, যোগীন্দ্রনাথ সরকার স্মৃতি পুরস্কার, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত স্মৃতি পুরস্কার, নবকৃষ্ণ ভট্টাচার্য স্মৃতি পুরস্কার, লোকসংস্কৃতি পরিষদ পুরস্কার, কিশোর জ্ঞান বিজ্ঞান পত্রিকার দেওয়া শৈব্যা পুরস্কার, সারস্বত শিরোমণি পত্র ইত্যাদি অসংখ্য পুরস্কার-সম্মাননা। পেয়েছেন গৌরবময় আনন্দ পুরস্কার, সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার, পদ্মশ্রী সম্মান, সাহিত্য আকাদেমি ফেলোশিপ

আমাদের আদর্শের স্বরলিপিতে, অনুকরণ অনুসরণের সরণিতে ভবানীপ্রসাদ মজুমদার। মুখে হাসি, চোখে কৌতুকের ঝিলিক। ভীষণ আপন করে নিতে পারেন। অহমিকাবর্জিত অত্যন্ত সাধারণ জীবন যাপন। একবার দেখা হলেই পরের বার নিশ্চিত নাম মনে রাখবেন এবং হেসে স্বাগত জানাবেন। ভক্তরা ভিড় জমায়, স্বাক্ষরের, ছবি তোলার বায়না ধরে; অমলিন চিত্তে পূরণ করেন সে বায়না-আবদার। রাগ-বিরক্তি-অসন্তোষ বোধ হয় তাঁর অভিধানে নেই। অপাপবিদ্ধ শুচিতা মাখা হাসি ওষ্ঠ যেন বলতে চেয়েছে, ‘মানুষের এই ভালোবাসা, তাঁদের প্রিয়জন হয়ে উঠতে কজন পারে!ভবানীপ্রসাদ মজুমদার সক্ষম হয়েছেন প্রিয়জন হতে

বয়সের থাবা শরীরে। অন্যের সহায়তা প্রয়োজন হয় কোনও সময়। স্ত্রী পদ্মাদেবীকে দেখেছি ভীষণ আন্তরিক। ছড়া শিল্পীর যোগ্য সহধর্মিণী। এমন নারীর সহায়তায় অনেক অনেক পথ অতিক্রম করা যায়। পাশে আছেন মমতাময়ী হয়ে। লক্ষ্মীস্বরূপিণী নারী। আহ্বানে আপ্যায়নে অনুপ্রেরণায় অনুপমা। দীর্ঘ জীবন লাভের কামনা করি ভবানীপ্রসাদবাবুর। সুস্থ থাকুন। মুগ্ধতায় ভরিয়ে রাখুন। শ্রদ্ধায় আবেগে ভালোবাসায় তিনি থাকুন চির উজাগর সত্য-স্বপ্নের ফেরিওয়ালা হয়ে। প্রণাম অমিত প্রতিভাধর ছড়া শিল্পী ভবানীপ্রসাদ মজুমদার 

  

<