বটু কৃষ্ণ হালদার




   নিরহংকারী, সদাহাস্য,              মিতভাষী প্রিয় সাহিত্যিক          ভবানীপ্রসাদ মজুমদার









বটু কৃষ্ণ হালদার





 

লেখা শুরুর প্রথমে আমি আন্তরিক ধন্যবাদ জ্ঞাপন করব কিশোর বার্তা পত্রিকার সমস্ত পরিবারকে, কারণ আমার চোখে ভবানীপ্রসাদ মজুমদার শুধুমাত্র শিশুসাহিত্যিক নন, তিনি জড়িয়ে আছেন আমাদের আত্মা ও শৈশবের সঙ্গে। সেই মহান ছড়া সম্রাটকে নিয়ে কিছু লেখার সুযোগ কোনোমতেই মিস করতে চাইছি না। অসংখ্য ধন্যবাদ এই পত্রিকাকে, যারা এমন সুন্দর একটা বিষয় নিয়ে বিশেষ সংখ্যা করতে চলেছে। ছড়া সম্রাট ভবানীপ্রসাদ মজুমদারের প্রতিটি লেখাই সমাজের দর্পণ। তিনি আমাদের যা দিয়েছেন তা কখনোই মূল্যায়ন করা সম্ভব নয়। ভবানীপ্রসাদ মজুমদার নামটি সঙ্গে আমরা খুবই পরিচিত। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে তাঁর স্নেহভাজন হতে পারব, সেটা কখনও ভাবিনি

লেখালেখির জগতে আমি একেবারেই আনকোরা। কিছু পত্রপত্রিকা ও সংবাদ মাধ্যমে দৈনিক প্রতিবেদন লেখালেখি সূত্রে সাহিত্য জগতে পদার্পণ করি। তার সূত্রে কিছু সাহিত্য অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ পাই। সেইসব সাহিত্য অনুষ্ঠানে গিয়ে বেশ কিছু নামকরা সাহিত্যিক ও জ্ঞানী মানুষদের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন হুগলির রিষড়া থেকে প্রকাশিতসাহিত্যের আলোকপত্রিকার সম্পাদক ও অত্যন্ত জ্ঞানী মানুষ বরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর মাধ্যমে আমি ব্যক্তিগতভাবে ভবানীপ্রসাদ মজুমদারকে খুব কাছ থেকে প্রণাম করার সুযোগ পেয়েছি

ওই পত্রিকা বার্ষিক সাহিত্য অনুষ্ঠানে ছড়া সম্রাট ভবানীপ্রসাদ মজুমদারকে বিশেষ অতিথি করে আনার চিন্তাভাবনা করেছিল। উনি অনুষ্ঠানে আসতে পারবেন কি না অনুমতি নিতে ওঁর বাড়িতে যাওয়ার চিন্তাভাবনা করেন পত্রিকার সম্পাদক মহাশয় ও পরিচালন কমিটির সদস্যরা। আমিও সেই আলোচনা সভাতে উপস্থিত ছিলাম কমিটির সদস্য হিসাবে। সম্পাদক মহাশয় বরুণদাকে আমি ব্যক্তিগতভাবে আমার মনের ইচ্ছা জানালাম যে আপনারা যদি ওঁর বাড়িতে যান, আপনাদের সঙ্গে কি আমি যেতে পারি? আমি যেতে চাই শুনে ভীষণভাবে আনন্দিত হয়েছিল সবাই। অবশেষে দিনক্ষণ ধার্য হয় এবং তিন-চারজন মিলে ওঁর বাড়িতে যাই। ওঁর বাড়িতে যাবার জন্য অনুমতি পাওয়ার পর আমার শরীরে এক শিহরন জেগে উঠেছিল। কারণ, শৈশবে যাঁর লেখা পড়ে উদ্বুদ্ধ হয়েছি, সেই মানুষটাকে একবার পা ছুঁয়ে প্রণাম করব যা আমার কাছে ছিল কল্পনার অতীত। আমার সেই স্বপ্ন পূরণ করেছিলেন বিশিষ্ট সাহিত্যিক সম্পাদক তথা আমাকে অত্যন্ত স্নেহ করেন এমন নিরহংকারী ব্যক্তিত্ব বরুণ বন্দ্যোপাধ্যায় দাদা। দিনক্ষণ ঠিক হল

দুর্গাপূজার মাস দুই আগে আমরা তিন-চারজন মিলে রওনা দিলাম। গাড়িতে যেতে যেতে মনে মনে ভাবলাম, স্বপ্ন দেখছি না তো? শরীরে শিহরন দিতে লাগল। ভাবতে ভাবতে পৌঁছলাম সেই স্বপ্নের কারিগরের মহাফেজখানায়। দরজায় বেল দিতেই এক ভদ্রমহিলা দরজা খুলে দিয়ে আমাদের সবাইকে বসতে বললেন। বসতেই আমি অবাক হয়ে গেলাম। রুমের চারদিকে হাজার হাজার বই সাজানো, টেবিলের চারধারে কাগজপত্র-পেন-খাতা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। বুঝতে পারলাম, কয়েক মাস পর বাঙালিদের প্রাণের উৎসব দুর্গাপূজা আর তার জন্যই ছড়া সম্রাট ভীষণরকম ব্যস্ত। সেই সঙ্গে উপলব্ধি করলাম, লিখতে গেলে আগে বেশি বেশি করে পড়তে হবে। উনি এসে চেয়ারে বসলেন। সেই সঙ্গে কুশল বিনিময় হল। আমি উঠে গিয়ে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলাম। তিনি মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করলেন। সেই সঙ্গে আমার পরিচয় জানতে চাইলেন। বরুণদা আমার পরিচয় দিলেন। নামটা শুনতে বললেন, “তোমার কয়েকটা ছড়া আমি পড়েছি, ভালো লেখো। আরও বেশি বেশি করে লেখো।আর বললেন, “লিখতে গেলে বেশি বেশি করে পড়তে হবে।

আমি মোহিত হয়ে কথাগুলো শুনলাম। আর একদৃষ্টিতে তাকিয়ে তাকিয়ে ভাবলাম সাহিত্যের উপর যার অগাধ বিচরণ, সেই মানুষটা এমন নিরহংকারী, সদাহাস্য, মিতভাষী—কী করে সম্ভব?

যাই হোক, সেই দিনটা ছিল আমার জীবনের এক চরম মুহূর্ত। হৃদয়ের মণিকোঠায় যে স্মৃতি রয়ে গেছে তা আজীবন ভোলার মতো নয়। ওইদিন আমি ভীষণরকম আনন্দিত ও আপ্লুত হয়েছিলাম। বাড়িতে ফিরে আমি সারারাত ঘুমাতে পারিনি। সেই অনুভূতি ছিল সম্পূর্ণ আলাদা, যা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়

বর্তমান সময়ে সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে শুধুমাত্র ভারতবর্ষের নয়, সমগ্র বিশ্বজুড়ে সাহিত্যচর্চার প্রতি আগ্রহ বেড়েছে। সেই সঙ্গে লেখক সংখ্যাও বেড়েছে। তবে প্রকৃত সাহিত্যিক হিসেবে এমনভাবে সমাজের বুকে নিজেদের মেলে ধরতে পারেননি। আজও সাহিত্যিক বলতে আমরা বুঝি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, সুকুমার রায়, উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, ভবানীপ্রসাদ মজুমদারের মতো লেখকদের। এর কারণ হল, এমন মহান ব্যক্তিরা নিজেদেরকে কখনোই মহান সাহিত্যিক বলে মনে করতেন না, কখনোই অহংকার করতেন না। সাধারণভাবে জীবন যাপন করতেন এবং নতুন নতুন সাহিত্যিকদের উৎসাহ প্রদান করতেন। কিন্তু বর্তমান সময়ে লেখক না হয়ে ওঠার কারণ হল অহংকার। দু-চার কলম লিখে দিলেই তারা নিজেদেরকে বড়ো বড়ো সাহিত্যিক বলে মনে করতে শুরু করেন। আর পয়সা দিয়ে কিছু পুরস্কার কিনে নিয়ে বাজারে নিজেদের ঢাক নিজেরা পেটান। কথায় আছে, প্রকৃত গুণীজনরা কখনও দেখানো ব্যাপারটাতে বিশ্বাসী নন। আর বর্তমান সময়ে সাহিত্যিকরা অল্প বিদ্যায় ভয়ংকরী হয়ে উঠেছেন, যার ফলে তাঁরা শুধুমাত্র পয়সা দিয়ে লেখা ছাপানো কিছু পত্রিকার পাতায় সীমাবদ্ধ হয়ে রয়েছেন আর ভবানীপ্রসাদ মজুমদারদের মতো সাহিত্যিকরা জনগণ, সাহিত্যপ্রেমীদের হৃদয়ের জায়গা করে নিয়েছেন

  

<