কৃষ্ণেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়


    সবুজবুড়োর সঙ্গে









কৃষ্ণেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়





 

সবুজবুড়ো কী মিষ্টি নাম না? হ্যাঁ, এই নামেই বহুজন তাঁকে চিনেছেন অনেককাল ধরে। এই ছদ্মনামের আড়ালেই তিনি দিনের পর দিন লিখে গেছেন বহু ছড়া, কবিতা, জোকস; এই নাম দিয়েই তিনি আয়োজন করেছেন চমৎকার সব ছড়া গড়ার প্রতিযোগিতা, যেখানে নামকরা সব ছড়াকার থেকে উঠতি লেখকরাও যোগদান করেছেন প্রবল উৎসাহ সহকারে। আবার এই নামের আড়ালেই তিনি ছোটোদের জন্যে লিখে গেছেন অনেক অনেক চিঠি, যা তাদের অনেক কিছু নতুন জিনিস জানিয়েছে, তাদের সাহিত্যে অনুরাগী করে তুলেছে, সর্বোপরি আনন্দে ভরে তুলেছে তাদের মন। আর এই সবুজবুড়ো নামের আড়ালে আসল মানুষটি কে জানো? তোমার আমার সবার প্রিয়, জনপ্রিয় ছড়াকার শ্রীযুক্ত ভবানীপ্রসাদ মজুমদার

মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়ে তখন বোধ হয় একাদশ শ্রেণিতে পড়ছি। টুকটাক লেখালেখি করি—এখানে ওখানে লেখা পাঠাই, কিছু কিছু ছাপাও হয়। বিশেষ করে ছড়া আর কবিতা লেখার দিকে তখন প্রচুর ঝোঁক। আর একটা নেশাও সেই সময় হয়েছিল, পত্রমিতালি পাতাবার নেশা। যাঁদের চিনি না, জানি না, তাঁদের সঙ্গে চিঠির মাধ্যমে যোগাযোগ হত। কী যে ভালো লাগত! সেইরকমই আমার এক পত্রবন্ধু ছিল, যার নাম ছিল গৌতম গলুই। সেও ছিল আমার মতো উঠতি এক লিখিয়ে, আর তার বয়েসও ছিল আমার মতোই। কিন্তু সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার, সে ছিল প্রায় আমাদের পাড়ারই কাছাকাছি, কারণ ঠিকানা দেখে তাই মনে হত। তো এইভাবে চিঠির আদানপ্রদান হতে-হতেই একদিন খুঁজে খুঁজে চলে গেলাম তার বাড়ি। কথা হল, গল্প হল, আড্ডাও জমে গেল বেশ। বলা যায় তারপর থেকে বেশ বন্ধুত্বই গড়ে উঠল তার সঙ্গে

এরপর একদিন হঠাৎই তার কাছে শুনলাম যে, বিখ্যাত ছড়াকার ভবানীপ্রসাদ মজুমদার নাকি আমাদের পাড়ারই কাছাকাছি থাকেন। শুধু তাই নয়, তাঁর বাড়িতে গৌতমের নাকি নিয়মিত যাতায়াত আছে, এমনকি সে তাঁকে ভবানীদা বলেই ডাকে। ব্যস, সঙ্গে সঙ্গে ধরে পড়লাম গৌতমকে। এই মানুষের সঙ্গে আলাপ না করলে তো চলবে না। তারপর প্রায় দিন দশেকের মধ্যেই চলে গেলাম তাঁর বাড়ি

সেটা বোধ হয় ১৯৮১-৮২ সাল হবে। সেই থেকে যে ছড়া সম্রাটের সঙ্গে মনের সান্নিধ্য গড়ে উঠল, তা আজও অম্লান। তার মধ্যে কখন যে তিনি অন্য অনেকের মতো আমারও ভবানীদা হয়ে উঠেছেন, কবে থেকে তাঁর অনুপ্রেরণায় খাতার পর খাতা ছড়া লিখে ভরিয়ে ফেলেছি, তা নিজেই জানি না

প্রথম দিকে তো সপ্তাহে দু-দিন করে যেতাম তাঁর বাড়ি। তার মধ্যে যা লিখতাম তাই তাঁকে দেখাতাম, তিনি মতামত দিতেন। বহু লোক তাঁকে লেখা জমা দিয়ে যেত, আমিও দিতাম। তাঁর জানাশোনা পত্রপত্রিকায় তিনি সেগুলো নিজেই পাঠাতেন। কখনো-বা পাঠাতে উৎসাহ দিতেন। এইভাবে তাঁর সঙ্গ আর সাহচর্যে কত যে পত্রিকায় লিখেছি তখন!

এইভাবে চলতে চলতে কয়েক বছর কাটল। তখন গৌতমও যেমন, আমিও তাঁর শিষ্যের মতোই হয়ে উঠেছি প্রায়। এমন সময় একদিন আমাদের মাথায় পাগলামি চেপে বসল যে আমরা একটা নতুন পত্রিকা বার করব। যদিও এর আগে ভবানীদার নিজের সম্পাদনায় সম্ভবত একটা দুটো পত্রিকা ছিল, সে-ও ছড়ারই পত্রিকা। কিন্তু এবার যেটার পরিকল্পনা করা হল, তা বৈশিষ্ট্যের দিক দিয়ে বাংলায় প্রথম; শুধুমাত্র লিমেরিককে কেন্দ্র করে একটি লিটল ম্যাগাজিন, যার নামহিং টিং ছট

প্রবল উন্মাদনায় আমরা লেগে পড়লাম পত্রিকা বার করতে। ভবানীদার সঙ্গে গৌতম, আমি আর অন্য একটি ছেলে, যার নাম এই মুহূর্তে আর মনে নেই, এই হল আমাদের সম্পাদকীয় টিম। লেখাপত্র জোগাড় করা, পত্রিকা সাজানো, ছাপাখানা ঠিক করা, কাগজ কেনা—সে এক হইহই রইরই ব্যাপার। তারপর একসময় সেই পত্রিকা ছেপে বেরোল, পশ্চিমবঙ্গের কোণে কোণে পৌঁছেও গেল সেই কাগজ। আর তারপর? বাংলার সমস্ত ছড়াকারদের আগ্রহের আর আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠল সেইহিং টিং ছট


 

বলা বাহুল্য, এই পত্রিকার সঙ্গে জড়িয়ে থাকাটা আমার সেই সময়ের নিরিখে ছিল জীবনের সবচেয়ে গর্বের বিষয়। কিন্তু তার চেয়েও বড়ো আনন্দের ব্যাপারটা ঘটল এর পর। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বিভিন্ন মানুষের সম্পাদনায় বেরোতে শুরু করল ছোটো ছোটো কিছু পত্রিকা, যার মূল বিষয় ছিল সেই একই—লিমেরিক। অর্থাৎ হিং টিং ছটের সাফল্যে উৎসাহিত এবং অনুপ্রাণিত হয়ে বহু জায়গা থেকে প্রকাশ পেতে লাগল লিমেরিকের বিভিন্ন পত্রিকা। এ কি আমাদের পক্ষে কম গৌরবের কথা?

যাই হোক, অন্যান্য ছোটো কাগজের মতোই সেই পত্রিকাও দু-তিনটে ইস্যুর পর যথারীতি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তবে ভবানীদার সঙ্গে আমার যোগাযোগ থামেনি। এরপর ভবানীদা ওভারল্যান্ড সংবাদপত্রে যোগ দিলেন। তখনও সেখানে একটি বিভাগ তিনি দেখতেন, সবুজবুড়ো নামেই। সেখানে আমিও কিছু কিছু লিখেছি। ইতিমধ্যে আমাদের নিজস্ব একটি নাচের স্কুল গড়ে উঠল। প্রথম বছরেই বিশেষ অতিথি হিসেবে ভবানীদাকে নিয়ে এলাম। স্কুলের স্যুভেনিরেও তিনি লেখা দিলেন। আর তার মধ্যেই একটা উল্লেখযোগ্য ঘটনা, যেটা না বললেই নয়। আমার একটি ছড়ার বইভূতের বৃন্দাবন’, যার ভূমিকা লিখে দিয়েছিলেন তিনি, আবার সেই বইটা উদ্বোধনের দিনেও সেই বই প্রকাশ হল তাঁর হাত দিয়েই

এইভাবে নানা সময়ে, নানা ঘটনায়, জীবনের প্রতিটা বাঁকে বাঁকে ছড়ার জাদুকর ভবানীপ্রসাদ মজুমদারের সঙ্গে আমার ওঠাবসা, যার প্রতিটি মুহূর্ত আমার মনে গাঁথা হয়ে আছে, আর থাকবেও। সময়ের অভাবে দেখাসাক্ষাৎ হয়তো ইদানীং কমে গেছে, কিন্তু মনের মণিকোঠায় তিনি যেমন উজ্জ্বল হয়ে ছিলেন, তেমনই থাকবেন। জয়, সবুজবুড়োর জয়




কে সেই  কবি ?

কৃষ্ণেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়

 

                                    ভয়-ডর      সব ভুলে ভাই      পড়ছি ছড়া,

বাহবা      বাহ্ কী মজা,      এ কার গড়া?

নীরবে      পড়তে গিয়ে      ফেলছি হেসে,

প্রভূত      আনন্দটা      পাচ্ছি শেষে।

সাব্বাশ      বলছি আমি      আপন মনেই,

দমাদম      প্রণাম ঠুকি      পরক্ষণেই।

 

মজাদার      রসকদমে      মন ভরে যায়,

জুড়াল      প্রাণটা যেন      এই কবিতায়।

মরীয়া      হয়েই ভাবি,      কার এ লেখা?

দারুণ এক      সূর্য দিল      হঠাৎ দেখা!

রসরাজ      নামটি খুঁজে      বার করিলাম,

ভবানী      প্রসাদ মজুম-      দার তাঁরই নাম।

 

 

  

<